সাদা পোশাকে রঙিন বাংলাদেশ
সূর্যোদয় তখনো হয়নি। ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে; কিন্তু বাংলাদেশের আকাশে আজ অন্যরকম এক ভোর হলো। হয়েছে অন্যরকম এক সূর্যোদয়। যা রচিত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিউ জিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে। মুমিনুলের হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১১ সেনা মিলে কোটি কোটি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন অন্যরকম অনুভুতির নতুন প্রভাত। ২১ বছর ধরে অধরা হয়ে থাকা নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রথম জয়।
সাদা পোশাকের ক্রিকেটে রঙিন বাংলাদেশ। নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়েছে ৮ উইকেটে। নিউ জিল্যান্ডের ছুড়ে দেওয়া ৪০ রানের টার্গেট বাংলাদেশ পাড়ি দেয় ২ উইকেট হারিয়ে ৪২ রান করে। সময়ের ব্যবধানের কারণে মুমিনুলরা যখন নিউ জিল্যান্ডকে হারানোর জন্য লড়াই শুরু করেছেন বাংলাদেশে তখন রাত ৪টা। আর মুশফিকুর রহিমের বাউন্ডারি থেকে যখন জয় সূচক রান আসে, তখন ঘড়ির কাঁটা ৬টা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ দলের এ রকম সাফল্য দেখার জন্য অনেকেই তখন রাতের ঘুম হারাম করে টিভি পর্দায় চোখ রেখে করেছেন বিজয় দর্শন। দেখেছেন বাউন্ডারি মারার পর মুশফিকুর রহিমের বাঘের মতো করে গর্জন। শুনেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ জয়োধ্বনি।
চতুর্থ দিনই বাংলাদেশ জয়ের ঘ্রান পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারপরও কারো মুখ ফুটে বের হয়ে আসেনি প্রকাশ্যে জয়ের কথা। টেস্ট ক্রিকেট ধৈর্য্যরে খেলা। ২২ গজের পিচে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যেমন নিজেদের অসম্ভব ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছেন, কথা বলার ক্ষেত্রেও ছিল একই রকম ধৈর্য্য। আবেগকে করেছেন নিয়ন্ত্রণ। কারণ নিউ জিল্যান্ডের কঠিন কন্ডিশনে যেখানে বাংলাদেশ হাবুডুবু খেয়েছে গত ২১ বছর, সেখানে জয় হাতের নাগালে–এ রকম শুধু কল্পনাই করা যায়। আবার বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছে প্রতিকুল পরিস্থিতিতে। গায়ে চিমটি কেটে যেন উপলদ্ধি করা গেল, না এটি স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। স্বপ্নকে বাস্তবে নামিয়ে আনা যায়। চেষ্টা করলে জেতা যায়। বাংলাদেশ সেই চেষ্টায় ব্রতি হয়ে জয় এনেছে প্রথম সেশনেই। ম্যাচ সেরা এবাদতের বিস্ফোরণ বোলিংয়ে নিউ জিল্যান্ড ১০ ওভার ৪ বল খেলে মাত্র ২২ রান যোগ করে ১৬৯ রানে গুটিয়ে যায়। জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০ রান পেতে লাঞ্চের সময় হয়ে যায়। আম্পায়ার লাঞ্চের সময় বাড়িয়ে দেন। আর তাতেই অধরা হয়ে থাকা জয়ের সন্ধান পেয়ে যায় বাংলাদেশ ১৬ ওভার ৫ বল খেলে। রচিত হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাফল্যে সেরা পালক। নতুন বছরের শুরুতেই পেল বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পেল আবার প্রথম জয়। দুই টেস্টের সিরিজে বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১-০ ব্যবধানে। দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হবে ৮ জানুয়ারি ক্রাইস্টচার্চে।
পঞ্চম দিন বাংলাদেশ যে পরিকল্পনা করেছিল, তার অনেক আগেই নিউ জিল্যান্ডকে বধ করে। ভয় ছিল ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংস খেলতে নামা অভিজ্ঞ রস টেলরকে নিয়ে। ৩৭ রানে অপরাজিত থাকা এই ব্যাটসম্যান যদি বাঁধার প্রাচীর হয়ে উঠেন। তা’হলেইতো সব শেষ! কারণ রস টেলর উইকেটে টিকে থাকা মানে বাড়বে টার্গেট, কমবে সময়। কঠিন হবে জয়। কিন্তু জয়ের নেশায় উন্মাতাল হয়ে থাকা বাংলাদেশের যোদ্ধাদের ঠেকায় কে? চতুর্থ দিনই হিংস্র হয়ে উঠা এবাদত আজ আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেন। সাথে ছিলেন তাসকিনও। এই দুজনে মিলে নিউ জিল্যান্ডের চার ব্যাটসম্যানকেই (একজন অপরাজিত ছিলেন) কোনো রান করতে দেননি। দুজন নেন দুটি করে উইকেট ভাগাভাগি করে। যেখানে শেষ প্রলেপ দেন মিরাজ।
যে রস টেলরকে নিয়ে ভয় ছিল,শঙ্কা ছিল, সেই টেলরকে দিয়েই শুরু হয় আঘাত বাংলাদেশের। এই আঘাত হানতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। দিনের দ্বিতীয় আর নিজের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই টেলরের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেন এবাদত। টেলর আগের দিনের ৩৭ রানের সাথে ৩ রান যোগ করতে পেরেছিলেন। পরের ওভারে এবাদত আবারো আঘাত হানেন। এবার তার শিকার হন কাই জেমিসন (০)। মিড উইকেটে অসাধারন ক্যাচ ধরেন শরিফুল।
এবাদত উইকেট নেবেন, আর তাসকিন চেয়ে চেয়ে দেখবেন, এটা কি হতে পারে? তাসকিনও তাল মেলালেন শেখানে। তিনিও মেতে উঠেন উইকেট পাওয়ার নৃত্যানন্দে। তিনিও তার পরের দুই ওভারে দুইটি উইকেট তুলে নেন। প্রথমে আগের দিনের আরেক অপরাজিত ব্যাটসম্যান রাচিন রবিন্দ্রকে (১৬), পরে টিম সাউদিকে (০)। রাচিনকে উইকেটের পেছনে লিটন ক্যাচ ধরেন। সাউদির স্ট্যাম্পে আঘাত হানেন। রস টেলর দলীয় ১৫৪ রানে আউট হওয়ার পর ১৬০ রানে পড়ে ৩ উইকেট। বাকি থাকে শেষ জুটি। বোল্ট ও ওয়েগনার জুটিকে সাথে সাথেই ভাঙ্গা যায়নি। তাসিকন (৫ ওভার) ও এবাদত (৪ ওভার) মিলে ৯ ওভার বোলিং করার পর দলপতি মুমিনুল দুই জনকেই বিরতি দিয়ে এক প্রান্তে শরিফুল ও অপরপ্রান্তে মিরাজকে নিয়ে আসেন। শরিফুল প্রথম ওভার কোনো রান দেননি। তবে মিরাজ এসে আর দেরি করেননি। বাড়তে দেননি টার্গেট। চতুর্থ বলেই বোল্টকে ফিরিয়ে দেন বদলি ফিল্ডার তাইজুল ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ ধরলে। এবাদত ২১ ওভার বোলিং করে ৪৬ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট। এটি তার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ইনিংসে ৫ বা ততোধিক উইকেট নেয়া। প্রথম ইনিংসে ৭৫ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। তাসকিন ৩৬ রানে নেন ৩ উইকেট। মিরাজের ১ উইকেট ছিল ৪৩ রানের বিনিময়ে।
১৬৯ রানে নিউ জিল্যান্ডের ইনিংস গুটিয়ে গেলে তারা এগিয়ে থাকে মাত্র ৩৯ রানে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা ছিল এক শ রানের নিচে টার্গেট রাখা। সেই পরিকল্পনা অনেক সহজ যায় বোলারদের কল্যাণে। ইনুজরির কারণে মাহমুদুল হাসান জয় না থাকায় সাদমানের সাথে গোড়া পত্তন করতে আসেন নাজমুল হোসেন শান্ত। এবার শুরুতেই ভেঙে যায় উদ্বোধনী জুটি। দলীয় ও ব্যক্তিগত ৩ রানে সাদমানকে ড্রেসিং রুম দেখিয়ে দেন বোল্ট। শুরুতেই এমন আঘাতে বাংলাদেশ বেশ সাবধানি হয়ে উঠে। নাজমুল ও দলপতি মুমিনুল জুটি বেঁধে কোনো ঝুঁকিতে যাননি। ধৈর্য্য ধরে পড়ে থাকেন ক্রিজে। ধীরে ধীরে আসতে থাকে রান। এভাবেই দুই জনেই পৌঁছে যাাচ্ছিলেন জয়ের বন্দরে। কিন্তু তখনই আউট হয়ে যান নাজমুল (১৭)। জেমিসনের বলে স্লিপে দাঁড়িয়ে ডান দিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে দৃষ্টিনন্দন ক্যাচ নেন অবসর নিতে যাওয়া রস টেলর। দলের রান তখন ৩৪। মুশফিক এসে দলপতির সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর আসে সেই ইতিহাস গড়া গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্ত। জেমিসনের বলে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে তিনি নিউ জিল্যান্ডে মাটিতে প্রথমবারের মতো লাল-সবুজের নিশানা উড়ার লগন এনে দেন।
এমপি/এসএ/