চ্যাম্পিয়ন হয়ে মেয়েদের অন্যরকম উদযাপন
স্তিমিত হয়ে পড়া ঘরোয়া ফুটবলে মেয়েদের ফুটবল যেনো প্রাণের ছোয়া। আগুনের পরশমনি। ক্লাব ফুটবল বা এ জাতীয় আসরে দর্শকরা মাঠেই আসেন না। জাতীয় ফুটবল দল দেশবাসীকে কবে শিরোপা এনে দিয়েছিল তা খুঁজতে ইতিহাসের পাতা দেখতে হয়। উপমহাদেশের ‘বিশ্বকাপ’ বলে পরিচিত সাফ ফুটবলের শিরোপা এখনো সোনার হরিণই হয়ে আছে। খেলার মাণও পড়েছে অনেক। সব মিলিয়ে বল যায় ছেলেদের ফুটবল মাঠে খেলা হলেও সেখানে প্রাণ নেই। এখানেই ব্যতীক্রম মেয়েদের ফুটবল।
বয়স ভিত্তিক ফুটবলে তারা বেশ কয়েকবার দেশবাসীকে শিরোপার বৃষ্টিতে ভাসিয়েছে। এ সবই সাফের আসর। অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৮ শিরোপা জেতার পর সবশেষ তারা উপহার দিয়েছে অনূর্ধ্ব-১৯ আসরের শিরোপা। কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে উপচে পড়া দর্শকদের উপস্থিতিতে চির প্রতিদ্বিন্দ্বি ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে এই শিরোপা নিজেদের করে নেয়। এক গোলে জিতলেও তাদের নান্দনিক খেলা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন দর্শকরা। আর সরাসরি টিভিতে সম্প্রচারের কারণে সারা দেশের অসংখ্য মানুষ।
শিরোপা জেতার পর মারিয়া-রিপা-আনাই-তহুরা-ঋতুপর্ণা-আফিদা-স্বপ্না-উন্নতি-আঁখিদের হৃদয় উজাড় করা উৎসব ছিল দেখার মতো। তাদের সাথে সেই উৎসবে স্টেডিয়ামে বসে শামিল হয়েছিলেন দর্শকরাও। খেলা শেষ হওয়ার পরও দর্শকরা স্টেডিয়াম ছেড়ে যাননি। মেয়েদের শিরোপা হাতে নিয়ে উৎসব করা পর্যন্ত তারা ছিলেন উপস্থিত। আর ক্ষনে ক্ষনে বাংলাদেশ বাংলাদেশ জয়োধ্বনি আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলেছিল। যা ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে বাড়তি পাওয়া।
নানান দিক দিয়েই বাংলাদেশের এই শিরোপা ছিলে উল্লেখযোগ্য। আসরে তারা ছিল অপরাজিত। একমাত্র দল হিসেবে কোনো গোল হজম করেনি। প্রতিপক্ষের জালে বল ডুকিয়েছে ২০ বার। সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন বাংলাদেশের রিপা। তার গোল সংখ্যা ৫টি। আসরের সেরা খেলোয়াড়ও তিনি। আসরে হ্যাটট্রিক হয়েছে দুইটি। দুইটিই লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। ভুটানের বিপক্ষে রিপা ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আফিদা করেছিলেন এই হ্যাটট্রিক দুইটি। এভাবেই গোটা আসর আলোকিত ছিল লাল-সবুজের পতাকায়।
মেয়েদের দ্যুতিতে মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) কমলাপুর স্টেডিয়ামে যেন রাত নেমে আসেনি। একদিকে ফ্লাড লাইটের আলো। সেই আলোতে রিপা-মারিয়াদের উল্লাসে রাতের আধার হারিয়ে গিয়েছিল। রাত প্রায় ৮টার দিকে খেলা শেষ হলেও দল বাফুফে ভবনে ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা পার হয়ে যায়। বাফুফের এই ভবন মেয়েদের যেন আপন ঠিকানা। নিজেদের বসতভিটাও তারা এতোদিন থাকেন না, যতোদিন থাকেন এই ভবনে। বলা যায় বছরের অধিকাংশ দিনই তাদের নীড় বাফুফে ভবন। নিজ নীড়ে ফিরে আসার পর সেখানেও চলে একান্ত নিজেদের মতো করে উৎসব। এর মাঝে আবার কেউ কেউ কয়েকটি টিভি চ্যানেল চলে যান লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। এক সময় ক্লান্ত শরীর বিছানায় হেলে পড়ে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন সবাই। ভোরের আলো ফুটে উঠে সবার চোখে-মুখে অন্য রকম আলোক রশ্মিতে। বেলা বাড়তে না বাড়তেই বেড়ে যায় তাদের ব্যস্ততা। সংবাদ কর্মীদের ভীড়। একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়েই চলেছেন সবাই। কিন্তু শুধু সাক্ষাৎকারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেককে আবার টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য গাড়ি এসে উপস্থিত। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক মিডিয়াতেও অনেকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আজকের সারাদিন তাদের উৎসব ছিল এই সাক্ষাৎকারের মাঝেই।
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে অধিনায়ক মারিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীকে আমরা সবাইকে একটা শিরোপা উপহার দিলাম। আর এ কাজটি করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। আমাদের খেলা দেখতে আসা দর্শকদেরও ধন্যবাদ আমাদের উৎসাহিত করার জন্য। আমাদের ভালো খেলার অনুপ্রেরণা ছিলেন দর্শকরা।’
আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় রিপা বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। অনেক আনন্দ করেছি। মাঠে এতো দর্শক এসেছিলেন। সব সময় তারা আমাদের অনুপ্রেরনা দিয়েছেন। আমরা তাদের হতাশ করিনি। আশা করবো দর্শকদের এ অনুপ্রেরণা আগামীতেও আমাদের প্রতি থাকবে।’
যার বলে গোল হয়েছিল সেই আনাই মুগিনী বলেন, ‘বলটা আমি মেরেছিলাম গোলের প্রত্যাশায়। আমি আশাবাদী ছিলাম। আত্মবিশ্বাসও ছিল। আমার গোলেই দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে-আসলে এ অনুভুতি বলে বুঝাতে পারবো না। আগামীতেও আমরা এভাবে ভালো করতে চাই।'
রক্ষনভাগের আঁখি বলেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। এর আগেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমি চাই যখন যে দলে খেলবো যেনো এভাবেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। এবার আশা করবো জাতীয় দলও আগামীতে ভালো করবে। আমরা যদি সবাই এক সঙ্গে জাতীয় দলে খেলতে পারি, আশা করি সেখানেও ভালো কিছু করতে পারবো।'
অনুর্ধ্ব-১৮ আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলের খেলোয়াড়রা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ১০ লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন। এবার বাংলাদেশ দল যখন চ্যাম্পিয়ন হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী মালদ্বীপ সফরে। দেশে ফিরে আসার পর এবারো তিনি খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দেবেন এমনটা আশা করছেন দলের খেলোয়াড়রা।'
এমপি/এএস