মেসি জাদুর পর ফার্নান্দেজ ঝলকে আর্জেন্টিনার জয়
প্রথমার্ধে নিষ্প্রাণ খেলা। বলার মতো নেই কোনও উল্লেখযোগ্য আক্রমণ। উপরন্ত গোল হজম করার হাত থেকে কোনও রকমে রক্ষা। প্রথমার্ধে গোল না হতেই পারে। কিন্তু যে খেলা আর্জেন্টিনা খেলেছে তাতে করে চারিদিকে হতাশা ছাড়া আরও কিছুই ছিলনা। গভীর রাত যেন আরও গভীর হয়ে উঠে। মেসি ভক্ত আর্জেন্টিনার দর্শকদের দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।
তাহলে কি মেসি গোল পাবে না? আর্জেন্টিনার হয়ে কেউ ত্রাতা হয়ে উঠবেন না? ফুটবল যাদুকর মেসির শেষ বিশ্বকাপ খালি হাতেই থাকবে? এ রকম দুর্ভাবনার মাঝেই দ্বিতীয়ার্ধে চেনা আর্জেন্টিনাকে দেখা যায়। দেখা যায় চেনা মেসিকে। আর ত্রাতা হয়ে উঠেন সেই মেসিই। তার যাদকুরি সেই বাম পায়ের কারিশমাতেই গোলের দেখা পায়। পরে সেখানে বদলি খেলোয়াড় ফার্নান্দেজের অসাধারণ গোল যোগ হলে ২-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টিনা। এই জয়ে দ্বিতীয় পর্বে যাওয়া লড়াইয়ে শামিল হলো মেসি বাহিনী। কেটে গেছে প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হারের আঁধার।
এই দুই দলের পয়েন্টই সমান ৩ করে। গোল গড়ও সমান-১। ৪ পয়েন্ট নিয়ে সবার উপরে পোর্যান্ড। ৩ পয়েন্ট নিয়ে সবার নিচে সৌদি আরব। ‘সি’ গ্রুপ থেকে ৪ দলেরই শেষ ষোলতে যাওয়ার সম্ভাবনা উন্মুক্ত। ৩০ নভেম্বর আর্জেন্টিনা খেলবে পোল্যান্ডের বিপক্ষে। মেক্সিকোর প্রতিপক্ষ সৌদি আরব।
আর্জেন্টিনার চাই জয়, মেক্সিকোর হার এড়ানো কিংবা ড্র। মেক্সিকোর এ রকম ভাবনার কারণ আগের ম্যাচে পোল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে ১ পয়েন্ট পাওয়া। এই ম্যাচে ড্র করতে পারলে ২ পয়েন্ট নিয়ে তারা শেষ ষোলতে যাওয়ার জন্য শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হবে সৌদি আরবের। এদিকে শনিবার এই গ্রুপের আগের ম্যাচে পোল্যান্ডের কাছে ২-০ গেলে সৌদি আরব হেরে যাওয়াতে আর্জেন্টিনার জয়টা ‘অত্যাবশ্যকীয়’ হয়ে উঠে। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে দুই দলের দৃষ্টি ভঙ্গির প্রতি ফলন দেখা যায় একাদশ সাজানো নিয়ে।আর্জেন্টিনা ১-৪-৪-২ পদ্ধতিতে খেলতে নামে। যেখানে মেক্সিকোর ফরমেশন ছিল ১-৫৩-২ পদ্ধতিতে। প্রথম ১০ মিনিট আর্জেন্টিনার দখলে বল ছিল শতকরা ৭৮ ভাগ। মেক্সিকো বল পায়ে রাখতে পেরেছিল মাত্র ২২ ভাগ। তবে এ সময় কোনও দলই সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। তবে এসময় মেক্সিকো আর্জেন্টিরা গোল পোষ্ট লক্ষ্য করে একটি শট নিতে পেরেছিল, যা আবার পারেনি আর্জেন্টিনা। মেক্সিকো একটি কর্নারও আদায় করে নেয়। আজর্জেন্টিনা কোনও কর্ণার পায়নি।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মেক্সিকো খেলায় ফিরে আসতে থাকে। যে কারণে বল পজিশনেও তাদের অগ্রগতি হয়। ২০ মিনিট পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বল পজিশন ৭৮ থেকে নেমে ৬৭-তে নেমে আসে। মেক্সিকোর বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ ভাগে। এই ২০ মিনিটেও দুই দল তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। দুই দলের খেলা ছিল ছন্দহীন।বিশেষ করে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে আর্জেন্টিনার খেলা ছিল রীতিমতো হতাশজনক। মেসি ঝলকের দেখা মিলেনি।
৩০ মিনিটেও দুই দল দেখার মতো কোনও সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। মেক্সিকোর রক্ষণদেয়াল ভাঙ্গার মতো আক্রমন গড়তে পারেননি মেসির। যে কারণে বল নিয়ন্ত্রণে আজর্জেন্টিনার দাপট অব্যাহত থাকে বেশি। নিয়ন্ত্রণ বেড়ে ৬৮-তে যায়। এ সময় পর্যন্ত মেক্সিকো ১০টি, আর্জেন্টিনা ৪টি ফাউল করে।
মেক্সিকো যেখানে প্রথম ১০ মিনিটেই কর্নার আদায় করে নিয়েছ, সেখানে আর্জেন্টিনা প্রথম কর্নার পায় ৩০ মিনিট পর। এই ১০ মিনিট আর্জেন্টিনা কিছু গোছালো ফুটবল খেলে ২টি কর্ণার আদায় করে নেয়। একটি সুযোগও তৈরি করে। দ্বিতীয় কর্ণার সরাসরি না মেরে ডি মারিয়াকে পাস দিলে, পরে ডি মারিয়া ক্রস থেকে মার্টিনেজের হেড বারের উপর দিয়ে চলে যায়। এটিই ছিল আর্জেন্টিনার বলার মতো এই অর্ধে একমাত্র সুযোগ। বল দখলে যথারীতি ছিল আজর্জেন্টিনার দাপট।
প্রথমার্ধেরে শেষ ৫ মিনিট ছিল আবার মেক্সিকোর। এ সময় আর্জেন্টিনা নিশ্চিত একটি গোল হজম করা থেকে রক্ষ পায় গোলরক্ষক মার্টিনেজের অসম্ভব দৃঢ়তায়। ৪৪ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে অ্যালেক্সি ভেগার শট গোলে ডুকার মুহুতের গোলরক্ষক ইমিলিয়ানো মার্টিনেজ ডান দিক দিয়ে শুন্যে শরীর ভাসয়ে দিয়ে বল গ্রিপে নিয়ে দলকে বাঁচান। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা ৬৭ ও মেক্সিকো ৩৩ ভাগ বল দখল রাখে।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আর্জেন্টিনা। প্রথমার্ধের ছন্নছাড়া খেলা থেকে বের হয়ে এসে তারা গোছালো ফুটবল খেলতে থাকে। মেসিও একটু একটু করে ঝলক দেখাতে শুরু করেন। এ সময় মেক্সিকো আরও বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ে। গোলরক্ষকসহ ১০ জন খেলোয়াড়ই তাদের সীমানায় নেমে আসে। উপরে ছিল মাত্র একজন খেলোয়াড়। যে কারণ কখনো আক্রমণে গেলে বল দেয়ার মতো কোনও খেলোয়াড় ছিল না মেক্সিকোর। এ সময় আর্জেন্টিনার বল নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।
মেক্সিকোর রক্ষণ মজবুত করার পরও আর্জেন্টিনা একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে ৫১ মিনিটে পেয়ে গিয়েছিল ফ্রি কিক। ক্লাব ফুটবলে এ রকম ফ্রি কিক থেকে মেসির ভুরি ভুরি গোল আছে। যে কারণে আর্জেটাইন দর্শকরা গোলের জন্য আশাবাদী হয়ে উঠেন। কিন্তু হতাশ করেন মেসি। তার নেওয়া ফ্রি কিক মৃত ঘোড়ায় পরিণত হয়। চলে যায় বারের অনেক উপর দিয়ে। কিন্তু ক্লাব ফুটবলের সেই মেসি ঝলক দেখা যায় খেলার ৬৪ মিনিটে। ৩০ গজ দূর থেকে এ বিখ্যাত বাম পায়ের যাদুতে ডি বক্সের বাইরে থেকে কার্ভিং শটে নিশানাভেদ করে কোটি কোটি দর্শকের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম থেকে মুক্ত করে উপলক্ষ এনে দেন।
গোল হজম করার পর মেক্সিকো রক্ষণ খোলাস ছেড়ে বের হয়ে গোল পরিশোধে মনোনিবেশ করে। এই সুযোগে আজর্জেন্টিনাও আক্রমণ গড়ার সুযোগ পায়। মেসি বেশ কয়েকবার বল নিয়ে বিপজ্জনকভাবে ডুকার চেষ্টা করেন। কখনও সতীর্থদের পাস দিয়ে নিজে জায়গা নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মেক্সিকোর রক্ষণের কারণে সফল হতে পারেননি। তবে সেখানে সফল হন বদলি খেলোয়াড় ফার্নান্দেজ। শর্ট কর্নার থেকে মেসির পা ছুঁয়ে বল পেয়ে বক্সের ভেতর থেকে ফার্নান্দেজ দুর্দান্ত প্লেসিং শটে দৃষ্টিনন্দন গোল করে মেসির শেষ বিশ্বকাপ অভিযানের রাস্তাকে মসৃন করে তুলেন।
এমপি/এএস