মিরাজের ব্যাটে বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য জয়
অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ১৮৬ রান তাড়া করতে নেমে ১৩৬ রানে নেই বাংলাদেশের ৯ উইকেট। পরাজয় অবধারিত। কিন্তু হার মানতে রাজি ছিলেন না মিরাজ। শেষ উইকেট জুটিতে মোস্তাফিজকে সঙ্গে নিয়ে একাই লড়াই করে বাংলাদেশকে ১ উইকেটে জয় এনে দেন।
মিরাজ-মোস্তাফিজ যখন জুটি বাঁধেন, তখন বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজন ৫১ রানের। মোস্তাফিজকে যতটা সম্ভব স্ট্রাইক কম দিয়ে নিজেই লড়াই শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হন। জয় সূচক রান আসে মিরাজের ব্যাট থেকেই। দুইজন জুটি বাঁধার সময় মিরাজের রান ছিল ১। জুটিতে যে ৫১ রান আসে সেখানে মিরাজের রান ছিল ৩৭, মোস্তাফিজের ১০। শেষ পর্যন্ত মিরাজ ৩৮ ও মোস্তাফিজ ১০ রানে অপরাজিত থাকেন।
বিশ্বকাপ ফুটবলের জোয়ারে সবাই ভাসছেন। মুখে মুখে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল আর মেসি, রোনালদো, নেইমারের নাম। ক্রিকেট নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? তারপরও ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক সমাবেত হয়েছিলেন। ক্রিকেটের প্রতি তাদের সেই ভালোবাসার সম্মান দিতে জ্বলে উঠেছিলেন বোলাররা। ৮ মাস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরে সাকিবের পাঁচ উইকেট আর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমে এবাদতের ৪ উইকেটে ভারতকে ১৮৬ রানে বোতলবন্দী করেছিল বাংলাদেশ। মামুলি সেই রানও বাংলাদেশ সংগ্রহ করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিল।
একপর্যায়ে রান ছিল ৪ উইকেটে ১২৮। সেখানে ৯ উইকেটে রান দাঁড়ায় ১৩৬। মাত্র আট রানে নেই ৫ উইকেট। ভাগ্য ভালো মেহেদি হাসান মিরাজ আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে হাজির হন। ৬.৩ ওভার উইকেটে টিকে থেকে ভারতীয় বোলারদের গোলা-বারুদ মোকাবিলা করে দলকে জয়ের বন্দরে নোঙর করান ৪ ওভার হাতে রেখেই। মিরাজের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে আড়ালে পড়ে যায় সাকিবের আট মাস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরেই ৩৬ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি। ম্যাচ সেরার পুরস্কারও উঠে মিরাজের হাতে।
বাংলাদেশের এই জয় থেমে যেতে পারত দলীয় ১৫৫ রানে। যখন মিরাজের রান ছিল ১৫। মোহাম্মদ সিরাজের বল ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন আকাশে। বল এতটাই উপরে উঠে ছিল যে উইকেটকিপার লুকেশ রাহুল দৌড়ে গিয়ে ফাইন লেগে বলের নাগালে চলে যান। গ্লাভস পরা হাতে নিশ্চিত আউট হন মিরাজ। কিন্তু মিরাজের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের মতোই লুকেলের হাত ফসকে বল বের হয়ে যায়। জীবন পেয়ে মিরাজ দুই রান নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। দীপক চাহারের পরের ওভারে তিন বাউন্ডারিতে ১৫ রান তুলে নেন।
মিরাজের এমন ব্যাটিং বাংলার আকাশ থেকে হারের কালো মেঘ কেটে জয়ের সূর্য উঁকি দিতে থাকলেও সেখানে ভরসা ছিল না। কারণ শেষ জুটি থাকায় ভারতের প্রয়োজন ছিল শুধুই একটি উইকেট। বিষয়টি মিরাজ বুঝতে পেরে নিজেই স্ট্রাইক ধরে মোস্তাফিজকে যতটা সম্ভব নিরাপদে রাখার চেষ্টা করে সফল হন। অনেক সিঙ্গেল রান তিনি নেননি। আবার ওভারের শেষ বলে এক রান ঠিকই বের করে নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রেখেছেন। আর এভাবেই এগিয়ে যান জয়ের বন্দরে। ভারতীয় দল ক্যাচ মিস করা ছাড়াও ওভার থ্রো মিস ফিল্ডিং করেও বাংলাদেশের জয়কে তরান্বিত করে তুলে।
পাঁচ ম্যাচ পর বাংলাদেশ পেল ভারতের বিপক্ষে জয়। সময়ের হিসেবে সাত বছর ছয় মাস। সর্বশেষ জয় পেয়েছিল ২০১৫ সালের ২১ জুন এই মিরপুরেই ৬ উইকেটে। সে বার তিন ম্যাচের সিরিজে এই জয় বাংলাদেশের সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিল। প্রথম ম্যাচে জিতেছিল ৭৯ রানে। পরে শেষ ম্যাচ হেরেছিল ৭৭ রানে। এবারও একইভাবে যাত্রা শুরু করেছে। ২০১৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে কি না তা জানা যাবে ৭ ডিসেম্বর সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে। আজকের মতো এই ম্যাচও অনুষ্ঠিত হবে মিরপুরে।
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথ এখন সর্বজন বিদিত। এই দ্বৈরথে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করেন আম্পায়াররা ভারতের পক্ষে বিতকির্ত সব সিদ্ধান্ত দিয়ে। গত ২ নভেম্বর অ্যাডিলেডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের পক্ষে আম্পায়ারদের নগ্ন পক্ষপাতিত্ব আম্পায়ারিং এখনো সবার কাছে টাটকা জীবন্ত। বাংলাদেশের জেতা ম্যাচ হাতছাড়া হয়েছিল। খেলা শেষে এর রেশ ছিল আসর শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভারতের মতো অপ্রতিরোধ্য না হলেও যেকোনো দলের কাছে সমীহ জাগানো। যে কারণে ম্যাচের আগের দিন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা বাংলাদেশকে হারানোর বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলেননি। বাংলাদেশকে নিয়ে যথেষ্ট সমীহ জাগানো কথা ছিল তার কণ্ঠে। মাঠে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যেন রোহিত শর্মার সমীহ করা কথাকেই ফিরিয়ে দেয় নৈপুণ্যের দ্যুতিতে। সঙ্গে যথারীতি টইটুম্বুর উত্তেজনার মসলা।
পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিংয়ের কবলে পড়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়েছিল। এবার ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ সেই সুযোগ আর হাতছাড়া করেনি। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগে জ্বলে উঠে ভারতকে হারিয়েছে ১ উইকেটে। ৮ মাস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরে সাকিব বল হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ৩৬ রানে ৫ উইকেট তুলে নিলে, সঙ্গে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমে পেসার এবাদত হোসেন ৪৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ভারত ৪২.২ ওভারে মাত্র ১৮৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। সেই রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তাড়াহুড়া না করে সাবধানে পথ চলা শুরু করলেও মাঝে পথ হারিয়ে অকুল ধরিয়ায় ভাসছিল।
নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবালের ইনজুরিতে দেশের ১৫তম অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে নামা দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লিটন দাসের ৪৩ রানের সঙ্গে সাকিবের ২৯, মুশফিকুর রহিমের ১৮, মাহমুদউল্লাহ ১৪ রান করলে বাংলাদেশ সহজ জয়ের দিকেই এগুচ্ছিল। কিন্তু দলীয় ১২৮ রানেই প্রথমে মাহমুদউল্লাহ, পরে মুশফিক আউট হলে প্রথম বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। এরপর দ্রুত হারায় আরও ৩ উইকেট। একপর্যায়ে দলের রান ৪ উইকেটে ১২৮ থেকে পরিণত হয় ৯ উইকেটে ১৩৬। ৪.৪ ওভারে মাত্র ৮ রানে নেই ৫ উইকেট। হারের প্রহর গুণতে থাকা বাংলাদেশ শিবিরে এরপর প্রেক্ষাপটে হাজির হন মিরাজ আর মোস্তাফিজ। রূপকথাকে হার মানানো ব্যাটিং শৈলী উপহার দিয়ে ভারত ‘বধ’ করেন। ভারতের মোহাম্মদ সিরাজ ৩২ রানে তিনটি এবং ওয়াশিংটন সুন্দর ১৭ ও কুলদ্বীপ সেন ৩৭ রানে নেন দুটি করে উইকেট।
এর আগে বাংলাদেশের জয়ের মঞ্চ তৈরি করে দেন আসলে সাকিব আল হাসানই। আট মাস পর ওয়ানডে ক্রিকেটে খেলতে নেমেই তিনি বল হাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য রান করা কঠিন হয়ে পড়ে। একমাত্র লুকেশ রাহুল করেন সর্বোচ্চ ৭৩ রান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল রোহিত শর্মার ২৭। সাকিব ৩৬ রানে নেন ৫ উইকেট। এটি ভারতের বিপক্ষে প্রথম আর ক্যারিয়ারে চতুর্থ। এবাদত ৪ উইকেট নিতে খরচ করেন ৪৭ রান।
এমপি/এসজি