চায়ের দোকানই ক্রিকেট ক্লাব!
মহাসংকটে জাতীয় দল। এই সংকটের কারণে মানসম্পন্ন খেলোয়াড়ের অভাব। ‘পঞ্চপাণ্ডব’র উপর ভরসা করে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু সেই পঞ্চপাণ্ডব এখন আর নেই। কোনো ফরম্যাটেই নেই মাশরাফি। টি-টোয়েন্টিতে নেই তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম। টেস্ট ক্রিকেটে নেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শুধুমাত্র সাকিব আল হাসানই আছেন তিন ফরম্যাটে। চার পাণ্ডবের অভাব যে কতোটা প্রকট তা বোঝা যায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের দিকে তাকালেই। একসঙ্গে চারজন না খেলাতে তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার মতো মানসম্পন্ন খেলোয়াড় নেই। যে কারণে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে বাংলাদেশ দল। এই মানসম্পন্ন বা চার পাণ্ডবের সমমানের ক্রিকেটার না পাওয়ার একমাত্র কারণ পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়া। গাছের গোড়া কেটে দিলে যেমন গাছ বাঁচানো যায় না, তেমনি পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে জাতীয় দলে। যা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জাতীয় দল।
এই পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে রয়েছে বিসিবির একটি কুচক্রি মহল। বিসিবির ভোটের রাজনীতিতে ‘কাউন্সিলর’ নিশ্চিত করতে গিয়ে তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটকে তারা হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। এক সময় যেখানে ৪০ থেকে ৫০টি ক্লাব তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটে অংশ গ্রহণ করত, সেখানে গত ৭ থেকে ৮ বছর যাবৎ সেই সংখ্যা নেমে আসছে মাত্র ২টিতে! ‘অদৃশ্য’ কারণে ২টির বেশি ক্লাবকে নাম এন্ট্রি করতে দেওয়া হয় না? এই দুইটি ক্লাবই হয়ে থাকে বিসিবির নীতি নির্ধারকদের পছন্দের। অন্য কোনো ক্লাব খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও নিয়ম-কানুনের নানা কারণ দেখিয়ে তাদের নাম এন্ট্রি করতে দেওয়া হয় না। অভিযোগ আছে যে সব কারণে ক্লাবগুলোকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, নিজেদের পছন্দের ক্লাবের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মই মানা হয় না। এরপর টস করে চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ নির্ধারণ করা হয়। তার মানে যেখানে ৪০/৫০টি ক্লাবের অধীনে কয়েকশ ক্রিকেটার নিজেদের মেলে ধরার প্রতিযোগিতায় শামিল হতেন, সেখানে একটি বলও মাঠে গড়ায়নি। তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটে একেবারে উঠতি বয়সের ক্রিকেটারই খেলে থাকেন। কিন্তু খেলা না হওয়ার কারণে এই সব ক্রিকেটাররা বিসিবিরি অধীনে একটি লিগ খেলা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়ে বিসিবির কর্তাদের নেই কোনো ভাবাবেগ! অথচ তারাই গলা ফাটিয়ে ক্রিকেটের উন্নতির কথা বলে যান!
মজার বিষয় গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ নির্ধারণ করতে গিয়ে বিসিবির নীতি নির্ধারকরা সদয় হয়ে ‘একটি’ ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন। যেখানে মহাখালী একাডেমি চ্যাম্পিয়ন ও উইঙ্গার রানার্সআপ হয়েছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই দুইটি ক্লাবও বিসিবির ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা কতিপয় পরিচালকদেরই ঘরানার। তাদের নাম এন্ট্রি করার ক্ষেত্রেও যথারীতি মানা হয়নি নিয়ম-কানুন। এখানে কী পরিমাণ অসচ্ছ্তার আশ্রয় নিয়েছে লিগ পরিচালনকারী বিসিবির স্ট্যান্ডিং কমিটি সিসিডিএম, তা বুঝা গেছে ক্লাব দুইটি সর্ম্পকে তথ্য জানতে গিয়ে। ক্লাব দুইটি সর্ম্পকে তথ্য জানতে চাইলে সিসিডিএমে কর্মরত স্টাফরা নানা টালবাহানা শুরু করেন। শুধুমাত্র ক্লাব দুইটির নাম দিয়েই তারা দায় এড়াতে চেয়েছিলেন। দুইটি ক্লাবের ঠিকানা কী? ক্লাবের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কারা? তাদের মোবাইল ফোন নম্বর কী?
এসব তথ্য জানতে চাওয়া হলে সিসিডিএম থেকে দেই দিচ্ছি করে তিন দিন পার করে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে সিসিডিএমের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগোযোগ করা হলে তার নির্দেশে পরে দুইটি ক্লাবের প্রতিনিধিদের নাম দেওয়া হয়। পরে যোগাযোগ করে জানা যায় দুইজনেই দুইটি ক্লাবের কোচ। মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানের ক্লাব উইঙ্গারের কোচ ফয়সাল মাহমুদ, মহাখালী ক্রিকেট একাডেমির কোচ রায়হান গাফফার সায়মন। কিন্তু এই দুইজনই খেলা ছাড়া ক্লাব সম্পর্কে কোনো তথ্যই দিতে পারেননি। উইঙ্গারের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কে তা জানাতে পারেননি ফয়সাল।
এলাকার নাজমুল নামে এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে তিনি ক্লাবটি দেখাশুনা করছেন বলে জানালেও তার অনুমতি ছাড়া মোবাইল নম্বর দিতে পারবেন না বলে জানান। সায়মন মহাখালী ক্রিকেট একাডেমির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের শুধু নিক নাম বলতে পেরেছেন, পুরো নাম জানেন না। তাদের মোবাইল ফোন নম্বরও দিতে পারেননি জানা না থাকার কারণে। সভাপতি রিফাতুল বিদেশ থাকেন। কোন দেশে থাকেন। তাও জানেন না। শুধু জানিয়েছেন ইউরোপের একটি দেশে থাকেন। সাধারণ সম্পাদকের নাম বলেন ‘মজিদ ভাই’। দুই জনই মোবাইল ফোন নম্বরের জন্য পরে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু পরে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ-ই ফোন ধরেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা দিলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সিসিডিএমের নিয়ম অনুযায়ী একটি ক্লাবকে নাম এন্ট্রি করতে হলে স্থায়ী অথবা অস্থায়ী ক্লাব ঘর থাকতে হবে। সমবায় অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন থাকতে হবে। থাকতে হবে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও ক্লাবের নির্বাহী কমিটিও। কিন্তু প্রথম দুইটিই ছিল না ক্লাব দুইটির।
উইঙ্গারের কোচ ফয়সাল ক্লাব থাকার কথা বললেও মহাখালী ক্রিকেট একাডেমির কোচ সায়মান কোনো রকম রাখডাক না করে সরসারি বলেন, ‘মনে করেন চায়ের দোকানই ক্লাব।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উইঙ্গারেরও কোনো ক্লাব নেই। সমবায় অধিদপ্তরের ক্লাব নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা ওয়ারেস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ক্লাব নিবন্ধনের আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদন লাগে। সেক্ষেত্রে ক্লাব ঘর থাকা জরুরি। ঢাকাপ্রকাশ-কে তিনি বলেন, ‘ক্লাব নিবন্ধন করতে হলে অবশ্যই স্থানীয় কিংবা ভাড়া ক্লাব ঘর থাকতে হবে। কারণ অনুমোদন দেওয়ার আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদন লাগে। ক্লাব ঘর না থাকলে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়া যাবে না।’
একটি ক্লাব নিবন্ধন দেওয়ার আগে অনেকগুলো শর্ত পূরণ করতে হয় বলে জানান তিনি। যেখানে এই দুইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্লাবের আর্থিক যোগান আসে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে।
কোনো রকম নিয়ম না মেনে ক্লাব দুইটিকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া সম্পর্কে সিসিডিএমের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো ক্লাবকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এটি আমার সময়ে হয়নি। আগের কমিটি করেছে।’
সিসিডিএমের আগের চেয়ারম্যান ছিলেন কাজী ইনাম। তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি জবাব দেননি। দুই চেয়ারম্যানের বিষয়টি উল্লেখ করে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি পুরো বিষয়টি না জেনে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দুই কমিটিরই সদস্য সচিব আলী হোসেন ছিলেন জানিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
আলী হোসেন আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ঢাকাপ্রকাশ-কে তিনি বলেন, ‘আমরা সব কিছু দেখেই অনুমোদন দিয়েছি।’ মহাখালী ক্রিকেট একাডেমির কোচ সায়মনের ‘মনে করেন চায়ের দোকানই ক্লাব’ কথাটি তাকে জানালে তিনি সেই আগের কথাই বলেন, ‘আমরা সব দেখেই অনুমোদন দিয়েছি।’
অনুমোদন দেওয়ার আগে তারা কি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলেন- জানতে চাইলে তিনি আবারও সেই একই কথা বলেন, আমরা সব দেখেই অনুমোদন দিয়েছি।’ এমনকি সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে বলেও জানান তিনি। পরে অস্ট্রেলিয়ায় রাত অনেক হয়েছে। তিনি ঘুম থেকে জেগে ফোন ধরেছেন জানিয়ে পরের দিন কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দেন।
এমপি/এসএন