সাকিব কি জাতীয় দলের খ্যাপ খেলোয়াড়!
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ‘খ্যাপ’ শব্দটি খুবই পরিচিত। এই খ্যাপ শব্দটি বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে ফুটবলের ক্ষেত্রে। জেলা-মফস্বল, এমনকি গ্রামে কোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট হলে অনেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ঢাকা থেকে জাতীয় দল বা আশপাশে থাকা ভালো মানের খেলোয়াড় নিয়ে যান। এসব খেলোয়াড়দের টাকা ঢাকায় বসেই সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হয়। কখনো সম্পূর্ণ পরিশোধ করা সম্ভব না হলে অগ্রিম দিয়ে যেতে হয়। সঙ্গে যাওয়া আসার ভাড়া, খাওয়া এসব তো থাকেই। এই সব খেলোয়াড়রা কখনো আগের দিন রাতে গিয়ে, কখনো খেলার দিন সকালে গিয়ে পৌঁছান। খ্যাপ খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকে আবার কিছু স্থানীয় খেলোয়াড়রা। তারপর কোনো রকম অনুশীলন ছাড়াই সবাই নেমে পড়েন।
খেলার ফলাফল যাই হোক, ‘খ্যাপ’ খেলোয়াড়দের কিচ্ছু যায় আসে না। জিতলে তাদের অনেক সময় বোনাস দেওয়া হয়। আর হারলে ‘খ্যাপ’ খেলোয়াড়দের যদি টাকা বকেয়া থাকে, সেই টাকা পরিশোধ করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করেন। হেরে গিয়ে যে স্থানীয়দের মন খারাপ, সে দিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পাওনাটা বুঝে নিয়ে তারা ঢাকার পথে রওনা দেন। এই ‘খ্যাপ’ খেলাকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তবে তিনি কোনো জেলা বা মফস্বলে গিয়ে খ্যাপ খেলেন না, তিনি খেলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে।
বিষয়টি অবাক করার মতোই। কিন্তু আদতে তাই হয়েছে। এবার নিউ জিল্যান্ডে বাংলাদেশ খেলবে পাকিস্তানের অংশগ্রহণে তিন জাতির টি-টোয়েন্টি সিরিজে। যে সিরিজকে ধরা হচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবেও। কিন্তু সাকিব গিয়ে সেখানে পৌঁছেছেন আজ স্থানীয় সময় সন্ধ্যায়। শুক্রবার নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে তিনি ২৪ ঘণ্টারও কম সময় পাবেন। দলের সঙ্গে সুযোগ হয়নি কোনো অনুশীলন করার। আবার তিনি অধিনায়ক। একজন অধিনায়ক হিসেবে তিনি দলকে নিয়ে কোনো পরামর্শ, পরিকল্পনা এমনকি প্রতিপক্ষ নিয়ে সতীর্থদের দিতে পারেননি কোনো পরার্মশও! এ যেন অনেকটা ‘খ্যাপ’ খেলার মতোই। এলাম, খেললাম। ফলাফল যাই হোক!
এশিয়া কাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে ‘বেটউইনার’ বিতর্ক মাথায় থাকার পরও বিসিবি সাকিবকেই বেছে নিয়েছিল অধিনায়ক হিসেবে। যাতে করে সাকিব তার মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে দলের দুঃসময় পাড়ি দিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। সহযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাকিব অধিনায়ক হওয়ার পর এশিয়া কাপের আগে কয়েকদিন দলকে নিয়ে একত্রে অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর এশিয়া কাপে দলের ভরাডুবি ঘটে। দেশে ফিরে এসে তিনি পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখান থেকে তিনি যান সিপিএল খেলতে উইন্ডিজে। সেখান থেকে তিনি দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আজ সন্ধ্যায়।
এই যদি হয় একজন অধিনায়কের ভূমিকা তাহলে অধিনায়ক ও দলের একজন সাধারণ খেলোয়াড়ের মাঝে পার্থক্য কী থাকল? চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির কাউন্সিলর সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর সাকিবকে অধিনায়ক করারই পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘একজন ইনডিসিপ্লিন খেলোয়াড়কে কোন যুক্তিতে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক করা হয়? সাকিব অধিনায়ক হওয়া দূরের কথা, দলেই থাকার কথা নয়। যে দলকে লিড করবে সে হবে চরিত্রবান, অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। তার কথা সবাই শুনবে। দলকে বেশি বেশি সময় দিবে। এটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু সে ফটোসেশনেই নেই। দলের সঙ্গে অনুশীলনেও নেই।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির কাউন্সিলর সিরাজউদ্দিন মো. আলমগীর
তিনি বলেন, ‘সাকিব হচ্ছে একজন পিউর বিজনেসম্যান। আমার মনে হয় না সে এখন আর ক্রিকেট খেলতে চায়। পঞ্চপাণ্ডবের চারজনই তো খেলছেন না। সাকিবকে ছাড়া দুই বছর পর আমাদের খেলতে হবে না। কিন্তু বিসিবির সমস্যাটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না যে তাকেই অধিনায়ক করতে হবে। কিসের এত ভয়?’
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট
সাকিবের কাছে আরও দায়িত্বশীলতা আশা করলেও এখানে ম্যানেজমেন্টের দায় দেখছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। তিনি বলেন, ‘সাকিবকে যখন অধিনায়ক করা হয়েছে, তাকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখানে আমি দায় দেখছি ম্যানেজমেন্টের। তারা ছুটি দেওয়ায় তো সাকিব যেতে পেরেছে। ছুটি না দিলে কি সে যেতে পারত? সাকিবের ক্ষেত্রে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে অন্য ৫ জন খেলোয়াড়কে কি এই সুবিধা দেওয়া হত? আমি মনে করি সবার ক্ষেত্রে সমান বিচার করা উচিত।’
এদিকে নাম প্রকাশ না করে জাতীয় দলের সাবেক এক অধিনায়ক বলেন, ‘সাকিবের আমলনামা টান দিলে, এমন একজন খেলোয়াড় কখনো জাতীয় দলের অধিনায়ক হতে পারে না। আমার মনে হয় বিসিবি এখানে সাকিবের বড় নামটা ব্যবহার করেছে যাতে করে আলাদা গুরুত্ব পাওয়া যায়। কারণ বাবর আজম, কেন উইলিয়ামসন, রোহিত শর্মাদের পাশে সাকিবের নামটা তো মানানসই। সাকিব এখানে সাইনবোর্ড।’
এমপি/এসজি