সাকিব কি আদৌ চুক্তি করেছিলেন?
সব কিছুই যেন রকেট গতিতে হয়ে গেল? চুক্তি হলো, বিতর্ক হলো, আবার বাতিলও হলো। সময় লেগেছে ২০ দিনেরও কম? এই চিত্রনাট্য বিশ্বব্যাপী জুয়া খেলার অন্য লাইন প্রতিষ্ঠান বেটউইনারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের সঙ্গে সাকিব আল হাসানের চুক্তি নিয়ে। বাংলা চলচিত্র ‘হাওয়া’ নিয়ে দর্শকরা যেমন বুদ হয়ে আছেন, সাকিব কাণ্ড তেমনি দর্শকরা বুদ হয়েছিলেন! ‘হাওয়া’ দর্শকদের অন্তর ছুঁয়ে গেছে। দিয়ে যাচ্ছে নির্মল আনন্দ। কিন্তু সাকিবের ঘটনা সবার অন্তরে ‘ক্ষত’ সৃষ্টি করেছে। তুমুল সমালোচনা আর বির্তকের পর সাকিব চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই চুক্তি বাতিল করা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। সাকিব কী আসলেই বেটউইনারের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন!
কারণ, চুক্তি হওয়ার পর ১৯ দিনের (ফেসবুক হিসেব অনুযায়ী) মাথায় তা বাতিল করা কী আদৌ সম্ভব? আর সাকিব চাইলেও প্রতিষ্ঠান কি তা মেনে নেবে? এখানে নোটিশ পিরিয়ড দেওয়ার সময়ও ছিল না। তা ছাড়া এ জাতীয় চুক্তি হয় কমপক্ষে এক বছরের জন্য। যেখানে মিনিমাম একটা নোটিশ পিরিয়ড থাকে, যা কমপক্ষে এক থেকে দুই মাস। সব কিছু হয় দুই পক্ষের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে।
সাকিবের চুক্তির বিষয়ে জানা আর বাতিল করা সবই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়েছে। এখানে স্থায়ীত্ব ছিল ১৯ দিন। এটা কম বেশিও হতে পারে। কারণ সাকিবের এই বিতর্কিত চুক্তি সবার নজরে আসে তার ফেসবুকে পেজে ছবি দিয়ে তিনি নিজে জানানোর পর। সেই দিনটি ছিল ২ আগস্ট। আর তিনি ফেসবুক থেকে মুছে ফেলেন ২০ আগস্ট। চুক্তি বাতিলের বিষয়টি সাকিব প্রথমে বিসিবিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন, পরে লিখিতভাবে। কিন্তু চুক্তির কোনো কাগজ-পত্র তিনি বিসিবিকে দেখাননি বলে জানা গেছে একটি সূত্রে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের তাদের প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দূত করে থাকে। এ রকম বেশ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও আইনজীবির সঙ্গে সাকিবের চুক্তি নিয়ে ঢাকা প্রকাশের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। তাদের সবার কথার মিল ছিল এক জায়গাতে, চুক্তি বাতিল করতে হলে মিনিমাম একটা নোটিশ পিরিয়ড থাকে। সেটা মানতে হয় দুই পক্ষকেই। আবার সাকিবের মতো চুক্তি করে এত অল্প সময়ে তা বাতিল করার নজির করপোরেট জগতে বিরল বলেও উল্লেখ করা হয়।
নগদের হেড অব কমিউনিকেশন জাহিদুল ইসলাম সজল বলেন, যেকোনো সময় যে কেউ বের হয়ে যেতে পারে। সেটা আসলে চুক্তিতে উল্লেখ থাকে। সেক্ষেত্রে সাধারণত বলা থাকে, কয় মাসের নোটিশ পিরিয়ড থাকে। এটা আসলে কয় মাসের হবে সেটা নির্ভর করে তার বার্গেনিং পজিশন কতটা শক্ত।
বিস্তা ইলকট্রনিক্সের পরিচালক উদয় হাকিম বলেন, ‘চুক্তিটা হয় সেলিব্রেটিদের সঙ্গে। যে কারনে আমরা খুব এটা নিয়ে কড়াকাড়িতে যাই না। এতে করে তার জন্যও সহজ হয়, আমাদের জন্যও সহজ হয়। যারা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে আসেন তারাতো সম্মানীয় মানুষ। যে কারণে আইনগত বিষয়গুলোকে অতটা কড়াকাড়ি করে দেখা হয় না।’ চুক্তির টাকা প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটাও নির্ভর করে দুই পক্ষের মধ্যে। এখানেও সে রকম কোনো কিছু নেই যে এতো দিতে হবে, ততো দিতে হবে। কেউ তিন মাসের মধ্যে দেয়। কেউ ছয় মাসের মধ্যে দেয়। আবার দুই বছরের চুক্তি। দুইটি পেমেন্ট হবে। একটা পেমেন্ট আগেই দিয়ে দেয়। এটা আসলেই পুরোটাই দুই পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে।’
রবি মুঠো ফোন প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া বিভাগের আশরাফ বলেন, ‘চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে একটা মিনিমাম টাইম লাইন দেয়া থাকে। এটা আমাদের লিগ্যাল টিম বলতে পারবে। কতদিনের নোটিশ দিতে হবে এটার একটা লিগ্যাল ইস্যু আছে।’ চুক্তি আগে বাতিল করলে লেনদেনে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কত টাকা তাকে দেব, কত টাকা দেব না এটা চুক্তির ক্লজে উল্লেখ থাকে। এটা ভেরি করে। এক একটা কেসে একেক রকম হয়। সেটা দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে ফাইনাল হয়।’
ওয়ালটনের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রবিউল ইসলাম মিল্টন বলেন, ‘কোনো এক পক্ষ যদি আগ্রহ অনুভব না করে সেক্ষেত্রে দুই পক্ষ সমঝোতার ভিত্তিতে সরে আসতে পারে। এটা দুই পক্ষর মাঝে নির্ভর করে। যেমন মিরাজ আমাদের সঙ্গে এখনো আছে। মিরাজ যদি আগ্রহ না করে তাহলে জানিয়ে দেবে যে ভাই আমি আগামী মাস থেকে আমি আর আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাচ্ছি না। এখানে আমাদের নোটিশ পিরিয়ড আছে তিন মাসের। এই তিন মাস আগে আমাদের জানাতে হবে।’
একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আইনজীবি আনিসুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো পক্ষ যে কোনো সময় চুক্তি বাতিল করতে পারে। অনেক সময় শর্ত থাকে ৩০ দিনেরে নোটিশ দিয়ে বাতিল করতে হবে। অনেকগুলোতে থাকে যে কোনো সময় যে কোনো পক্ষ চুক্তি বাতিল করতে পারে। এটা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনের উপর নির্ভর করে।
নাম প্রকাশ করার না শর্তে বিসিবির সাবেক এক পরিচালক বলেন, ‘বিসিবি এটা আরও ভালোভাবে ইনভেস্টিগেট করতে পারত। সাকিব কবে চুক্তি করেছিল? কি ছিল এই চুক্তিতে? কিভাবে ফিরে আসল এত দ্রুত। ১০ কোটি টাকার চুক্তি যেটা মার্কেটে শুনা যায়, আদৌ চুক্তি ছিল কি না? তাকেওতো বুঝাতে হবে ভবিষ্যৎয়ের জন্য। কীভাবে প্লেয়ারদের আ্যাটাক করছে। সাকিবের মতো প্লেয়ার যদি জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে জুনিয়ররা তো আরও সহজে তাদের ফাঁদে পা দেবে। সেই জিনিষগুলো দেখে, তদারকি করে প্রয়োজনে একটু সময় নেওয়া যেত।’
সাকিবের স্বল্প সময়ে চুক্তি করে আবার তা বাতিল করা নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা খুবই টাফ। আমার কাছে মনে হয় প্লানটাই এরকম ছিল। আমরা ধারণাটা সত্যি নাও হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তাই মনে হয়। আমাদের সঙ্গে চুক্তি করে যে কেউ ১৫ দিনের মধ্যে বের হয়ে যাবে মনে হয় না আমরা সে সুযোগ দিতাম।’
আরেকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত বলেন, ‘১৫ দিনের মধ্যে চুক্তি বাতিলের ঘটনা এ যাবৎ কালে শুনিনি। এভাবে চুক্তি বাতিল করলে অ্যাম্বাসেডরের কোনো সমস্যা না হলেও সেই প্রতিষ্ঠানের সুনামে আঘাত লাগবে। তখন হয়তো অনেকেই ভাববে যে সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো সমস্যা আছে।’
এমপি/এমএমএ/