বাংলাদেশের জুয়ার আইন এবং সাকিবের চুক্তি
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭২’র সংবিধানে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’কিন্তু নতুন করে আর আইন প্রণয়ন করা হয়নি। ১৮৬৭ সালের আইনই বলবৎ থেকে যায়।
এই আইন প্রণয়ন করেছিল ব্রিটিশরা তার উপনিবেশগুলোর জন্য। এই আইনের ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ এই আইন প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ নামে অভিহিত হবে। ৩ ধারায় বলা আছে, এ ধরনের জুয়া খেলা দণ্ডনীয় অপরাধ। যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।’ এই আইনটি ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে আসে ২০১৯ সালে ক্যাসিনো কাণ্ডে। এ সময় যে সব ক্লাবে ক্যাসিনো চলত, সে সব ক্লাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হানা দিয়ে ক্লাবগুলো সিলগালা করে দেয়। এখনো ক্লাবগুলো সিলগালা অবস্থাতেই আছে। তখনই ধরা পড়ে এই আইনের দুর্বল দিক। যে কারণে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালানোর সময় মাদক, অর্থ পাচার ও অস্ত্র আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। এইসব আইনে সাজা বেশি।
আইনের এরকম দুর্বলতার কারণে ক্যাসিনো বন্ধ হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অভিজাত ক্লাব এবং আনাচে-কানাচে অহরহ জুয়া চলছে। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার সময় প্রতি বলে বলে অনেক সাধারণ মানুষ, এমনকি দিনমজুররাও বাজি ধরে থাকেন। এখানে কেউ জেতেন, কেউ নিঃস্ব হয়ে ফেরেন। পুলিশ অভিযান চালিয়েও এ সব বন্ধ করতে পারছে না। পুলিশ এলে সবাই সটকে পড়েন। তারপর আবার শুরু হয় বাজি ধরা। পুলিশের এ রকম অভিযানের পরই বাংলাদেশে যে ক্যাসিনো আছে কিংবা ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা হয়, তা আমজনতা জানতে পারেন। এবার সাকিবের কল্যাণে তারা জানতে পারলেন অনলাইনে জুয়া খেলার প্রতিষ্ঠান বেটউইনারকে।
বিশ্বব্যাপী এ রকম একটি জুয়া খেলার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের সঙ্গে সাকিবের সম্পৃক্ততা নিয়ে কথা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের সঙ্গে। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশের জুয়ার আইনটা পর্যাপ্ত আইন না। খুবই দুর্বল। নামে মাত্র শাস্তি। কিন্তু দেশের সামাজিক অবস্থা এবং সাকিবের নিজস্ব অবস্থান থেকে এটি করা ঠিক হয়নি।’
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘সাকিবের কাছে বিসিবি অসহায়ের মতে সারেন্ডার করেছে। এ রকম একটি ঘটনার পরতো অবশ্যই সাজার মুখোমুখি হওয়ার কথা।’
এ এম আমিন উদ্দিন, অ্যাটর্নি জেনারেল
আমাদের দেশের জুয়ার আইনটা পর্যাপ্ত আইন না। খুবই দুর্বল। নামে মাত্র শাস্তি। কিন্তু দেশের সামাজিক অবস্থা এবং সাকিবের নিজস্ব অবস্থান থেকে এটি করা ঠিক হয়নি। সাকিব আল হাসান এই দেশের তরুণদের জন্য একটা আইকন। সবাই তাকে ফলো করে। অনেকেই এটাকে ভালোভাবে নেবে না। জড়িত হতে পারে। এ জন্য সাকিবের এটি করা উচিত হয়নি। তার আরও ভাবনা-চিন্তা করা উচিত ছিল। প্রতিটি স্টেপ তার ভেবে-চিন্তে করা উচিত। এর আগেও তিনি আইসিসি থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন জুয়ার প্রস্তাব গোপন করার জন্য। তখন তিনি এসএমএস মুছেও ফেলেছিলেন। তাকে আরও সাবধানে পা ফেলতে হবে। সাকিবকে বিসিবিই নার্সিং করে গড়ে তুলে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তিনি প্রায় সময় জাতীয় দলে না খেলে ছুটি নিয়ে এ রকম বিজ্ঞাপন করে থাকেন। তাই তাকে জাতীয় দলে খেলার ব্যাপারে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধু সাকিব নয়, সবারই আগে দেশের কথা ভাবতে হবে।
ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন
আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে জুয়া অবৈধ। এটা আবার নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। কিছুদিন আগে আপনারা সবাই জানেন যে ক্যাসিনো বিজনেসের কারণে কতোগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কতোটি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট/সেক্রেটারিকে বহিষ্কার করা হলো। অনেকগুলো ক্লাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখনো বন্ধ আছে। এটা আমাদের দেশের জন্য একটা কলঙ্ক হয়ে আছে। তারপর আবার কয়েক বছর আগে আইসিসি থেকে সাকিবকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেন করা হয়েছিল। শুধুমাত্র জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে গোপন করেছিল। সে কিন্তু জুয়াও খেলেনি। কিংবা জুয়ার সঙ্গে একমত হয়ে ম্যাচ ফিক্সিং করেছে তাও না। শুধু গোপন করেছে। এই কারণে তার পানিশমেন্ট। এই রকম পানিশমেন্ট পাওয়ার পর সে কিভাবে আবার এ রকম সে শুভেচ্ছাদূত হন। শুভেচ্ছা দূত কিসের? বেটিং অনলাইনের নিউজ যেটা, এটা সুষ্পষ্টভাবে নৈতিকতার লঙ্ঘন বলতে পারেন। দেশের একজন সেলিব্রেটি হিসেবে তার কোনো স্ট্যার্ন্ডেই এটা কাভার করে না। সঙ্গে সঙ্গে আমি বলবো এটা বেআইনি এবং সে বেআইনি কাজটা করে, বেআইনিভাবে টাকা নিয়েছে। যারা তাকে টাকাটা দিয়েছে আলোচিত হওয়ার জন্য, তারা জেনেই দিয়েছে যে এরকম হবে। পরে এটা বাতিল হবে। কিন্তু তাদের যা যা হওয়ার (প্রচার) তা হয়ে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা, আইনগত বলেন, নীতি-নৈতিকতা বলেন, এগুলোতে আমার সমস্যা না। আইন না মানলে আইনের পথ তিনি দেখবেন। এটা আমার ইস্যু না। তার যদি নীতি-নৈতিকতা না থাকে, এটাও আমার ইস্যু না। আমার যে ইস্যুটা তিনি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটা আইডল। তার দেড় কোটি ফলোয়ার। সে যদি নিজে এ রকম জুয়ার গেঞ্জি পড়ে মানুষকে জুয়া খেলতে উদ্বুদ্ধ করে, এদেশের ইয়াং জেনারেশন বিপদগামী হবে। ঝামেলা হবে। সাকিবের যদি টাকা লাগে আমার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে যাক। তাও যদি তার লোভ একটু কমে। সাকিবের কাছে বিসিবি অসহায়ের মতে সারেন্ডার করেছে। এ রকম একটি ঘটনার পরতো অবশ্যই সাজার মুখোমুখি হওয়ার কথা। এখানে একটা ম্যাসেজ দেওয়া দরকার ছিল- তুমি সাকিব হও আর ব্যারিস্টার সুমন হও, তুমি যদি তৃণমূল বা তরুণদের নষ্ট করার মতো কোনো কাজ করো তা’হলে তোমাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এখন যেটা করা হলো বিসিবি আরেকটা সিগন্যাল দিল এ রকম, জুয়া-টুয়া যদি খেল আর যোগ্যতা যদি থাকে, তাহলে অসুবিধা হবে না?
এমপি/আরএ/