আমরা অসীম চাহিদা নিয়ে বাঁচতে চাই!
একদা এক রাজা তার উজিরকে প্রশ্ন করলেন, দুনিয়াতে অধিকাংশ মানুষ অসুখী কেন? এই যে দেখ, আমার কর্তৃত্বে এতবড় রাজ্য! কোনো কিছুর অভাব নেই। তবুও আমি মনের দিক থেকে সেই শান্তিটা পাই না। সবসময় অশান্তিতে কেন থাকি?
উজির কিছুক্ষণ নীরব থেকে উত্তর দিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আপনাকে ছোট একটি কাজ করতে হবে।
রাজা জানতে চাইলেন, কী কাজ?
উজির বললেন, আপনি একটি থলেতে নিরানব্বইটি দিনার রাখুন। আর থলেটির উপর লিখে দিন একশত দিনার। এরপর রাত্রিতে সেটা আপনার খাদেমের ঘরের সামনে ফেলে রাখুন।
উজিরের পরামর্শ মোতাবেক, রাজা সেটাই করলেন। রাতে সেই খাদেম বের হলেন এবং ঘরের সামনে একটি থলে পড়ে থাকতে দেখলেন। খাদেম থলেটি ঘরে নিয়ে গেলেন। গুনে নিরানব্বইটি চকচকে দিনার পেলেন কিন্তু পরক্ষণেই লক্ষ্য করলেন, সেই থলের উপরে লেখা আছে ‘একশত দিনার’। এক দিনার না পেয়ে বেচারা ঘরের সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ওই একটি দিনার খুঁজতে লাগিয়ে দিলেন। সারারাত চলল খোঁজাখুঁজি। কিন্তু পাওয়া গেল না।
এদিকে রাজা আর উজির আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন।
সকালে সেই খাদেম রাজ দরবারে আসলেন। রাজা দেখলেন, খাদেমের চেহারা মলিন, যেন বিরাট কিছু হারিয়ে যাওয়ার দুঃখে জর্জরিত খাদেমের মন।
এবার উজির রাজাকে বললেন, মহারাজ! ওই একের জন্যই আমরা এত অসুখী। আল্লাহ আমাদের যত নেয়ামত দিয়েছেন, তা হলো নিরানব্বইটি দিনারের মতো। অথচ আমরা সেগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি না।
আমাদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার বিরাজ করে। আমি সাধারণত যাদের সঙ্গে চলাফেরা করি কিংবা যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথাবার্তা হয়, তারা মোটামুটি সবাই সুস্থ, ভালো আয় করে, বাসস্থানের সমস্যা নেই।
তারপরও তাদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের কষ্ট দেখি। যেমন, কবে যে বাড়িটা তিন তলা থেকে চার তলা করতে পারব? কবে যে ৪র্থ গ্রেডে প্রমোশন পাব? কবে যে বাগানবাড়ি করতে পারব? ড্রয়িং রুমে ১টন থেকে ২টনের এসি কবে যে লাগাতো পারব? খুব নিঃসঙ্গ লাগে, খুব ডিপ্রেশনে আছি, ব্যাংকের সুদের হার কেন যে ০.০৫% কমে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি যখন হতাশার কথা শুনি, নিজের মধ্যে হাসি পায়। নিজে নিজে ভাবি, আল্লাহর রহমতে দুটি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, হাত-পা সচল আছে, এখনো অসুস্থতা নেই, লেখাপড়া করতে পেরেছি, সম্মানের সাথেই সমাজে চলাচল করছি, পরিবারের মধ্যে আছি, বন্ধু-বান্ধব আছে। সবই আল্লাহর রহমত। এত রহমতের মধ্যে বেঁচে থেকে আমাদের উচিত প্রতিনিয়ত আল্লাহকে ধন্যবাদ দেওয়া। তাকে স্মরণ করা। একবার ভাবুন তো, দুই মিনিটের জন্য যদি অক্সিজেন বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে কি করতেন? সকল ধরনের চাওয়া পাওয়া বাদ দিয়ে শুধু বেঁচে থাকতেই চাইতেন। হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চাওয়া হওয়া উচিত।
কি পেয়েছি, আল্লাহ কত দিয়েছেন, সেই হিসাব আমরা ততটা করি না, যতটা না পাওয়ার হিসাব করি। ওই অপূর্ণতার দিকে মনোনিবেশ আমরা এত কঠিনভাবে করে ফেলি যে, পাওয়ার হিসাব আর মনেই থাকে না। যার কারণে সব দিক থেকে শুধু বারবার অপূর্ণতাই চোখে পড়ে।
আমরা আসলে অসীম চাহিদা নিয়ে বাঁচতে চাই। কোনো কিছুতেই আমাদের সন্তুষ্টি নেই। সবসময় উপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। একবার নিচের দিকে তাকান। একবার একজন অন্ধ মানুষের কথা ভাবুন। যদি আপনার দুইটি চোখের বিনিময়ে একটা রাষ্ট্র লিখে দেওয়ার কথা বলা হয়, তবু আপনি রাজি হবেন না। অন্তত আমার ব্যাপারটা বলতে পারি, আমি হব না।
আমাদের যা আছে, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। দেখবেন খারাপ লাগবে না। ভালো থাকবেন, সুখে থাকবেন। আপনি একটিবার বিশ্বাস করুন, আপনি অনেক ভালো আছেন, দেখবেন, আপনি সত্যিই অনেক ভালো আছেন।
রিয়াজুল হক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
আরএ/