শত অসহনীয় ভোগান্তি লাঘব করেছে পদ্মাসেতু
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। মতিঝিল থেকে রিকশায় করে সায়েদাবাদ এলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। টিকিট কেটে বাসে বসলাম। উদ্দেশ্য খুলনা যাব। যাই হোক, দুপুর আড়াইটার দিকে বাস ছাড়ল। বিকাল ৪টার দিকে বাস মাওয়াঘাটে পৌঁছাল। ঘাটে এসে দেখি, বৃষ্টির মাত্রা কিছুটা বেশি।
প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে স্পিডবোট, লঞ্চ সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। নদী পার হওয়ার জন্য অনেকক্ষণ যাত্রীরা অপেক্ষা করছে। ঘাটে বাসের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল।
এরকম পরিস্থিতিতে কয়েকটা বাসের সুপারভাইজার মিলে একটা লঞ্চ ঠিক করল। ৬/৭টি গাড়ির যাত্রীরা সবাই সেই লঞ্চে উঠল। সেই সময়, স্বাভাবিক অবস্থায় একটি লঞ্চে একটি গাড়ির যাত্রীরা উঠত।
অনেকেই বলতে পারেন, নদীর অবস্থা খারাপ। এরকম পরিস্থিতিতে নদী পার হবার দরকার কী? বাড়ির জন্য রওয়ানা করার পরে যাত্রাপথে যত সমস্যাই আসুক, কেউই আর পেছনে ফিরে যেতে চায় না বা পারে না। এটা আমাদের মানুষের ধর্ম। ঈদের সময় মানুষ জানে রাস্তায় জ্যাম হবে, টিকিট পেতে গেলে সারারাত স্টেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তারপরও কিন্তু মানুষ সব কষ্ট সহ্য করে। আসলে পরিস্থিতিতে না পড়লে দূর থেকে এই অমূল্য আবেগ কখনো বোঝা যায় না।
যাই হোক, প্রবল ঢেউয়ের মধ্যেই আমাদের লঞ্চটি ছাড়ল। ঢেউয়ের উচ্চতা লঞ্চের উচ্চতাকেও যেন ছাড়িয়ে যেতে চাইছিল। লঞ্চটি ছেড়ে পঞ্চাশ মিটারও যেতে পারেনি, লঞ্চের একপাশ থেকে পানি ঢুকে আরেকপাশ থেকে বের হচ্ছে।
মানুষজন কান্নাকাটি শুরু করে দিল। প্রায় সবাই দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করল। লঞ্চটি এমনভাবে দুলছিল, মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে পানির মধ্যে সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে। এমনই ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পর কাওড়াকান্দি ঘাটে এসে পৌঁছালাম। যত সহজে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করলাম, এত সহজ কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা ছিল না।
এরকম অনেক হয়েছে। লঞ্চে পদ্মা পার হচ্ছি। হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নদীর মধ্যেই যেন বজ্রপাত পড়ছে। জীবনটা মনে হতো একদম গলার কাছে আটকে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি কেউ পদ্মা নদী পার হয়ে থাকে, তাহলে সে বুঝতে পারবে, কী বিভীষিকাময় অবস্থা চোখের সামনে বিরাজ করে।
অনেক রাত গেছে যখন বাস রাত ১১টার সময় কাওড়াকান্দি ঘাটে এসেছে, পদ্মা পার হব। কিন্তু ফেরি নেই। ভোর পাঁচটা/ছয়টার সময় ফেরিতে উঠতে হয়েছে। সারারাত বাসের মধ্যে বসে থাকতে হয়েছে। অথচ নদীটি পার হতে পারলে, আর মাত্র ৪০/৫০ মিনিটের রাস্তা বাকি। এই দুর্বিসহ কষ্টের যারা মুখোমুখি হননি, তারা কখনোই বুঝতে পারবেন না, ১০ মিনিটে পদ্মা নদী পার হতে পারলে কত সুবিধা হতো।
খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফেরি বন্ধ হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাওড়াকান্দি ঘাটে অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষা করেছে। দশ/বারো ঘণ্টায় নদী পার হতে না পেরে, অসুস্থ মানুষটি যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, মৃত মানুষটির স্বজনরা জানে পদ্মা নদী তাদের কাছে কতটা কষ্টের কারণ।
আর এখন ঢাকা-খুলনার দূরত্ব তিন থেকে সোয়া তিন ঘণ্টার। ঢাকা-গোপালগঞ্জের দূরত্ব দেড় থেকে দুই ঘণ্টার। সকালে ঢাকা গিয়ে কাজ সেরে আবার সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসা যাচ্ছে। ভাবাই যায় না! দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ যাদের নিয়মিত পদ্মা নদী পার হতে হয়, তাদের জন্য পদ্মা সেতু শুধুমাত্র একটা সেতু নয়, এটি তাদের দুর্বিসহ যন্ত্রণা লাঘবের নাম, তাদের চিকিৎসা সেবার নিশ্চয়তার নাম, তাদের জন্য সত্যিই এক আবেগের নাম এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একটি নতুন দ্বার উন্মোচনের নাম।
রিয়াজুল হক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
এসএন