ছাত্রদের চোখে একজন স্কুলশিক্ষক
আমরা যে জায়গায় অবস্থান করি না কেন, স্কুলশিক্ষকদের অবদান ভুলে যাবার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ হয়ে ওঠে আনপ্যারালাল অতিমানবীয় একজন। যিনি শুধু শিক্ষাই দেন না, শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতো আপন করে নেন, অভিভাবকদের কাছে হয়ে ওঠেন অতি আস্থার কেন্দ্র। ঠিক এরকমই একজন শিক্ষক হ্যানে রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. মজিবর রহমান শেখ।
তিনি স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১২ সালে। অথচ আজও সেখানে তার অভাব পূরণ করা সম্ভব হয়নি। শুধু সেই স্কুল কেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতে, মজিবর স্যারের মত শিক্ষক তো এমনিতেই চোখে পড়ে না।
ছাত্রদের চোখে মজিবর স্যার কেমন? এর উত্তর সত্যিই অবিশ্বাস্য। ৩০/৩৫ বছর আগে এসএসসি পাশ করা ছাত্ররা এখনো স্যারের কাছে অতি কৃতজ্ঞ। এখন তারা তাদের সন্তানদের জন্য মজিবর স্যারের মত শিক্ষক খুঁজে ফেরেন। মজিবর স্যারই যেন শিক্ষকতার মানদণ্ড।
শ্রদ্ধেয় মজিবর স্যারকে নিয়ে আর্টিকেল লেখার পর, তার সাবেক ছাত্ররা পিতৃসম স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা প্রকাশ করে যে মতামত দিয়েছেন, সেগুলো সত্যিই অবিস্মরণীয়। সবার সবটুকু মতামত দিতে গেলে, লেখাটা ৩ ফর্মার বই হয়ে যাবে। তাই দুই শতাধিক মতামত থেকে শুধুমাত্র কয়েকজনের মতামতের চুম্বক অংশ দেওয়া হলো এবং তাদের সকলেই ২৫/৩০ বছর আগে এসএসসি পাশ করে স্কুল ছেড়েছিলেন-
মাহমুদ হোসেন রাজিব: আজ মনে পড়ে স্যারের সেই অটল সাহসী পদক্ষেপে চলন যেন মুক্ত এবং অপার সম্ভবনাময় নতুন প্রজন্মের বিকশিত হওয়ার প্রতিকৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা উজ্জীবিত করে গোটা জাতির মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি। তার চওড়া বুকের ছাতি গর্বিত হবার অফুরান্ত শক্তি অবিচল আত্মার আন্তরিকতায় ভরপুর আর শিশুর মত হাসি মমের মত মন পাইনি আজও আর একটি। তিনি নির্ভীক, তিনি ইউনিক। মাঝে মাঝে বলি, সময়, স্থান কাল পাত্রে পুরুষ যদি হও, এমনই ব্যাঘ্র তবহে। টাকা সম্পদের মোহ থেকে থেকে দুরে থাকার শিক্ষা পেয়েছি স্যারের কাছ থেকে। সকল অবস্থায় বেঁচে থাকার স্পৃহা পাই স্যারের বিভিন্ন উপদেশ থেকে। কৈশোরের উদ্দিপনায় যৌবনের উন্মাদনয় বিপদগামী হতে মুক্ত হতে পারার কৌশল পেয়েছিলাম স্যারের কাছ হতে।
খুরশিদ আলম: বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে আমি আজও আমার এই মহান স্যারকে স্মরণ করি। আমাকে স্যার শুধু ছাত্র নয়, সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। মজিবর স্যার একালে একজনই হয়। স্যারের ভালোবাসা, শাসন, অনুপ্রেরণা সবসময় মিস করি। ছাত্রদের প্রতি গভীর ভালোবাসা, যত্নের সহিত পড়ানো ও বুঝানোর পদ্ধতি স্যারকে অন্য স্যারদের থেকে আলাদা করেছে। আমি গর্বিত স্যারের মতো একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন এমন একজন শিক্ষক যার কলমের তুলি দিয়ে অনেক হারিয়ে যাওয়া ছাত্রকে নতুন জীবন দিয়েছেন। এই মহান স্যারের সম্বন্ধে আমি যত লিখি তা সত্যিই কম হয়ে যাবে।
আনোয়ার সাদাত: স্যারের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। উনি শুধু আমার স্যারই ছিলেন না, বন্ধুও ছিলেন বটে। আমি ভাগ্যবান মজিবর স্যারকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম।
আতিক জামান: স্যারের কাছে আমার কখনো কোনো টাইম ছিল না। কখনো সকালে কখনো সন্ধায়। স্যার ভীষণ ভালবাসত আমাকে। স্যারের আদরমাখা শাসন আর ভালবাসা ভীষন মিস করি।
শাহজালাল: আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্যার। ইচ্ছে করে স্যারের পায়ে চুমু খেতে। আমি গর্বিত স্যারের মতো একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। আমি গণিতে কাঁচা ছিলাম। নবম শ্রেণির আগে যখন স্যারের কাছে পড়া শুরু করলাম, দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে অবাক হলাম আমি। একজন শিক্ষক কীভাবে দক্ষ করে তুলতে পারেন তার ছাত্রকে। আমি যখন নবম থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম তখন গণিতে ১০০ পেয়েছিলাম।
মাসুদ রানা: স্যার আমাকে তার সন্তানের মত দেখতেন। স্যার শুধু পড়াতেন না, পড়ানোর সময় যতবার আজান হতো ততবার সঙ্গে করে মসজিদে নিয়ে যেতেন নামাজের জন্য। অঙ্কের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাটাও স্যারের কাছ থেকে পেয়েছি। আল্লাহ স্যারকে নেক হায়াত দান করুন।
নূর-এ-আলম বাদল: স্যারের অসংখ্য ছাত্রের মাঝে আমি তার নিকট বিশেষ স্নেহভাজন ছিলাম,যেটা কখনো ভুলতে পারব না।
শফিকুল ইসলাম: আমি খুব ভাগ্যবান এমন একজন স্যারের ছাত্র ছিলাম। আমরা ছয় ভাই বোনের মধ্যে পাঁচ জন স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি।
মিজানুর রহমান: দক্ষ মানুষ গরার কারিগর ছিলেন আমাদের মজিবর স্যার।মহান আল্লাহর দরবারে স্যারের জন্য অনেক অনেক দোয়া শুভকামনা ও ভালোবাসা রইল।
জিকরুল হক: স্যারের অবদানের কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না । যতই বলি কম বলা হবে। তাই লিখে শান্তি পাচ্ছি না, মনও ভরছে না । শুধু প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে স্যারের সকল প্রকার মঙ্গলের জন্য দোয়া করছি।
শহিদুল ইসলাম: একজন শিক্ষক যখন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেন তখন কী আর তাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায়? খুলনা বিভাগে আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে কি না আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানা নেই যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষকের বিজ্ঞাপনে চলেছে। তার জ্ঞানের দীপ্তি এতই ব্যাপক ছিল যে, একজন ‘মজিবর স্যার’ ছাপিয়ে গিয়েছেন একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্যার একজন মহান কামার ছিলেন, তিনি জানতেন একখণ্ড লোহাকে কীভাবে হাতিয়ার করা যায়।উনি ছিলেনএকজন শৈল্পিক স্বর্ণকার, উনি জানতেন কীভাবে সোনাকে ডিজাইন করতে হয়। উনি ছিলেন একজন মহান রেস্টোরার, উনি জানতেন কীভাবে নস্ট হয়ে যাওয়া, রঙ জ্বলে যাওয়া মহামুল্যবান শিল্পকর্মকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে হয়।
আশরাফুল রনি: যে ভাষায় স্যারের প্রশংসা করি না কেন তা কমই মনে হবে। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় এই ভেবে যে, এ রকম একটা মহান স্যারের সান্নিধ্যে অনেক সময় কাটিয়েছি। স্যারের হাতের ঘুশি একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। এত এত স্মৃতি যা লিখে শেষ করা যাবে না।
আনিসুর রহমান: স্যারের মতো শিক্ষক এখন লাখে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। এত সহজভাবে অঙ্ক বোঝাতে পারতেন সত্যিই অবিশ্বাস্য। স্যারের কারণেই সম্মানের সঙ্গে কিছু করে খেতে পারছি। এখনো স্যারের সেই ট্রেডমার্ক ঘুসি মিস করি। ছাত্রদের জন্য সব সময় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। সকল অভিভাবক স্যারের উপর ভরসা করত।
গোলাম কিবরিয়া সুমন: মানুষ গড়ার একজন দক্ষ কারিগর আমাদের প্রিয় মজিবর স্যার। তার মতো একজন মহান শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরে আমি গর্বিত।
লতিফা হেলেন হীরা: প্রকৃতপক্ষে স্যার তার সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো করে দেখতেন। স্যারের অঙ্ক করানোর ধরনই ছিল অন্যরকম। পাঁচ দিস্তা কাগজ দিয়ে খাতা বানাতাম। কম কাগজের খাতা স্যার একদমই পছন্দ করতেন না। অঙ্ক যদি একটু ভুল হতো সেটা আমাকে পাঁচ বার করতে হতো, আর কোনো দিন যেন আমার অঙ্ক ভুল না হয়। উৎপাদকে বিশ্লেষণ এমনভাবে করাতেন মনে হতো যেন আরও আরও অঙ্ক করি। আশ্চর্য বিষয় এখনো যদি উৎপাদক আমাকে করতে দেওয়া হয় আমার ইনশাআল্লাহ কোথাও ভুল হবে না। এটা নিশ্চয়ই স্যারের কৃতিত্ব। আর পাঁচ দিস্তা কাগজ পাঁচ দিনেই শেষ। স্যারের কাছে আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ। স্যারের প্রচেষ্টার জন্য আমি নিশ্চয়ই ভালো রেজাল্ট করেছিলাম।
কেএম ওলিউর রহমান: সত্যিই স্যার অনেক মহান। আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে স্যার কোেনাদিন বেতন চাইতেন না।
আবু বকর সিদ্দীকি: বর্তমান সমাজে একজন মজিবর স্যারের বড্ড অভাব । মুখ দেখে ছাত্রদের মনে ভাষা পড়ার মত স্যারদের আজকাল আর পাওয়া যায় না। শাসনের সঙ্গে সঙ্গে স্যারদের মায়া মমতাগুলোও যেন ডিজিটালাইজেশনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কিরে মুখ শুকনো কেন, সকালে খেয়ে আসিসনি-এ রকম কথা ডিজিটাল যুগের স্যারেরা বলে কিনা আমি জানি না। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। বলতেন যেতে হবে অনেক দূর।
শাহজাহান আলী: স্যারের ভালোবাসা, শাসন, অনুপ্রেরণা সবসময় মিস করি। স্যারের সঙ্গে দেখা হলেই ভালোবেসে কাছে টেনে হাতে আলতো করে হাসি মুখে ‘ঘুষি’ মেরে কেমন আছিস বল, কথাটা আজ ও মনে পড়ে।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সম্প্রতি ফেসবুকে ফ্রেশের একটি বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। যেখানে একটি স্কুলের একজন শিক্ষককে নিয়ে কিছু বলতে বলা হয়েছিল? সেই বিজ্ঞাপনের মতামতেও দেখলাম, শ্রদ্ধেয় মজিবর স্যারকে নিয়ে শিক্ষার্থীরা মন্তব্য করেছে। ভাবা যায়! শিক্ষার্থীরা মজিবর স্যারকে কতটা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এই হচ্ছেন মজিবর স্যার, যিনি সবসময় হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন তার ছাত্রদের, যেন ছাত্রদের জন্যই জীবন।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক