৩২ বছর শিক্ষকতার পর ফেয়ারওয়েল কেন নয়?
জ্বরের কারণে অফিসে যেতে পারিনি। রুমে শুয়ে আছি। আব্বা হঠাৎ মাথার কাছে এসে বললেন, এখন কেমন লাগছে?
বললাম, খেতে ইচ্ছা করে না, আর ক্লান্তিভাব আছে। তারপর বিভিন্ন বিষয়ে আব্বার সাথে কথা হচ্ছিল। এরমধ্যে আব্বার কর্মক্ষেত্র হ্যানে রেওলয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নিয়ে কথা উঠল। স্কুলের কথা তুলতেই তাকে কিছুটা বিবর্ণ লাগছিল। হঠাৎ অভিযোগের সুরে বলে বসলেন, এমন স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবনটা পার করলাম, আমাকে ফেয়ারওয়েল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
আমার আব্বা মো. মজিবর রহমান শেখ দীর্ঘ ৩২ বছর চাকরি করার পর অবসর নিলেও তাকে স্কুল থেকে কোনো বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। যে প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১০/১২ জন শিক্ষক, সেখানে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হবে না, এটা অবাক করার বিষয়। অবসরের সাথে সাথে ফেয়ারওয়েল না দেওয়া গেলেও পরে তো দেওয়া যেত। অথচ আব্বা অবসর নিয়েছেন ১০ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। স্কুলে শুনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় কিন্তু স্কুলের শিক্ষকদের কোনো পদক্ষেপ দেখলাম না।
কয়েক বছর আগে দেখলাম স্কুলে রিইউনিয়ন হয়েছিল। যারা রিইউনিয়নের উদ্যোক্তা, আমি নিশ্চিত তারাও বিষয়টা জানে না।
আব্বা হ্যানে রেলওয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮০ সালে যোগদান করে ২০১২ সালে অবসরে যান। অনেক জায়গায় হ্যানে রেলওয়ে স্কুল পরিচিত ছিল আব্বার নামে। মাত্র কয়েজন সহকর্মীর সাথে ৩২ বছর দীর্ঘ সময়। অথচ তারাই তাদের একজন সহকর্মীর ফেয়ারওয়েলের আয়োজন করেনি। তিনি দীর্ঘদিন বোর্ডের প্রধান পরীক্ষক ছিলেন। এখনো বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা তার খোঁজ-খবর নেন।
তিনি কখনো স্কুল কামাই করতেন না। ছুটি নিতে বললেও ছুটি নিতেন না। বিনা ছুটিতেই তিনি বছর পার করতেন।
আব্বা তার তিন সন্তানকেই রেলওয়ে স্কুলে পড়িয়েছেন। আমরা তিন ভাই-ই ক্লাস সিক্স থেকে পড়ে এসএসসি দিয়েছি। আব্বার যুক্তি ছিল, ‘আমার সন্তান যদি আমার স্কুলে না পড়ে, তাহলে অন্য মানুষ কেন তাদের সন্তানদের এই স্কুলে পাঠাবে।’ অথচ সেখানকার অন্য অনেক শিক্ষকই কিন্তু সেই কাজটি করেননি।
মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই কারণ ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হ্যানে রেলওয়ে স্কুলের ইতিহাসে একমাত্র আমিই বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিলাম। আমার ছোট ভাই জিপিএ-৫ পেয়েছিল। আমরা সন্তানরা যে স্কুলের সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছিলাম, সেই স্কুল আব্বাকে কী দিল?
এখনো চলার পথে আব্বার অনেক পুরোনো প্রতিষ্ঠিত ছাত্রদের সাথে দেখা হয়। আব্বার কথা জিজ্ঞেস করে। তাদের জীবনে আব্বার অবদানের কথা স্মরণ করে। অথচ আব্বার কর্মস্থান যে তাকে শেষ মূল্যায়ন করল না, সেটা কী তার সাবেক ছাত্ররা জানে?
যেকোনো দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠানে গুণী ব্যক্তিদের কদর না থাকলে, সেই দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠান এগোতে পারে না, বরং পিছিয়ে যায়। এখন অনেকের কাছেই শুনি, আমাদের সেই স্কুলটার অবস্থা সেরকমই হয়েছে।
এখন যারা শিক্ষকতা করছেন, অনেকেই আব্বাকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন। আপনাদেরও অবসরের সময় আসবে। আপনাদের ফেয়ারওয়েল শিক্ষার্থী ও সহকর্মী শিক্ষকদের মাঝে থেকে হোক, সেই প্রত্যাশা সবসময়।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক, (লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)।
এসএন