হবিগঞ্জের নিরব নিভৃত পল্লীগুলো এখন শিল্পনগরী
মাত্র কয়েক বছর পূর্বেও গ্রামগুলোতে সন্ধ্যা নামলেই বিরাজ করত শুনশান নিরবতা। শুনা যেত চারদিকে শিয়ালের ডাক। একটি গাড়ি গ্রামে প্রবেশ করলে দেখতে বেড়িয়ে আসত লোকজন। যাদের সকালের ঘুম ভাঙ্গত পাখিদের কলরবে এখন তাদের ঘুম ভাঙ্গে কলকারখানার শব্দে। এক সময় লোকজন ধান কাটার পর অলস সময় পার করত এখন তাদের চারদিকে শুধু এখন চলছে কর্মযজ্ঞ। এমন পবিবেশ বিরাজ করছে হবিগঞ্জ জেলার নবগঠিত শায়েস্তাগঞ্জ, মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলার নিরব নিভৃত পল্লীগুলোতে।
পল্লীগুলোতে এখন একের পর আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। গ্রামীণ পরিবেশের জায়গায় এখন বিরাজ করছে শহরের পরিবেশ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সহজলভ্যতা আর মহাসড়ক দিয়ে সহজে যোগাযোগের কারণে উদ্যোক্তারা বেছে নিয়েছেন পাহাড় ঘেষা এই জনপদকে। রেল অথবা সড়কযোগে ঢাকা ও চট্রগ্রাম থেকে সিলেট যাবার পথে মাধবপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধার চত্তর নামক স্থানে এসে রাস্তার দুই দিকে তাকালে কেবল চোখে পড়বে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন কোন শিল্পনগরী?
সিলেট বিভাগের প্রবেশদ্বার মাধবপুর উপজেলার জগদিশপুর, নোয়াপাড়া, বেজুড়া, শাহপুর, বাঘাসুরা, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নুরপুর, বিরামচর, উবাহাটা ও বাহুবল উপজেলার মিরপুর, নতুন বাজার গ্রামে এসব শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। গড়ে উঠা শিল্প-কারাখানার মধ্যে- স্কয়ার, হবিগঞ্জ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক (প্রাণ-আরএফএল), আকিজ গ্লাস, যুমনা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক, টান্সকম গ্রুপ, চারু সিরামিক ইন্ডাঃ লিমিটেড, আরএকে সিরামিক,বাদশা গ্রুপ, সিপি বাংলাদেশ, ষ্টার সিরামিক্স, তাসহিদ কটন মিলস, মেঘনা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ, বেঙ্গল গ্রুপ, মার কোম্পানী, এন জে গ্রুপ, চায়না- বাংলা সিরামিক, এজি সিরামিক, সায়হাম গ্রুপ, এফএসএল গ্রুপ, এস এম গ্রুপ, রাখিন গ্রুপ, কে-কো কেমিক্যাল, ম্যাটাডোর গ্রুপ, সেলিম গ্রুপ,এফএল গামের্ন্টস, টিকে গ্রুপ, রূপায়ন গ্রুপ উল্লেখ্যযোগ্য।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় প্রায় শতাধিক শিল্প- কারাখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাধবপুর উপজেলায় ৬০টি শিল্প-কারাখানা গড়ে উঠেছে। স্কয়ার ডেনিম এবং স্পিনিং মিলের সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল বাবুল বলেন-ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এই এলাকায় শিল্প- কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে। শিল্প-কারখানা গড়ে উঠায় এলাকার লোকজনের কর্মসংস্থান যেমন সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি তাদের জীবন যাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে। ২০১৭ সালে হবিগঞ্জ যাত্রা শুরু স্কয়ার। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। এর মধ্যে ৮০ ভাগ স্থানীয় লোকজন কাজ করছে। ৫০/৬০ভাগ নারী শ্রমিক রয়েছে।
প্রাণ (আরএফএল) ইন্ডাষ্ট্রির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তৌহিদুল জামান বলেন-হবিগঞ্জ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক নামে (প্রাণ-আরএফএল) ২০১৪যাত্রা শুরু করে। মুলত প্রাণ (আরএফএল) সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে। বর্তমানে হবিগঞ্জ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্কে ৩৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগেও এসব এলাকায় একটি গাড়ীর শব্দ শোনা গেলে গ্রামের মানুষ বেড়িয়ে আসত দেখার জন্য। আর এখন সেখানে আধুনিক কলকারখানার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে এলাকাবাসীর। আধুনিক জীবনধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিল এলাকাবাসী। এখন সে এলাকার চেহারা পাল্টে গেছে পুরোপুরি। ৭/৮ বছর আগের এলাকার সাথে এখানকার তফাৎ এখন আকাশ পাতাল ব্যবধান। এখানে ক্রমেই বাড়ছে কলকারখানা; উৎপাদন হচ্ছে দেশীয় অনেক নতুন নতুন পণ্য। তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার লোকের কর্মক্ষেত্র।
তারা আরও জানান, কিছুদিন আগেও এসব এলাকায় কেউ জমি কিনতে চাইতো না। প্রতি একর বিক্রয় হত লাখ টাকায়। বর্তমানে সেই জায়গায় প্রতি শতক জমি বিক্রি হচ্ছে আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পযর্ন্ত। কোন কোন স্থানে দশ লাখের বেশি টাকা দিয়ে শতক কিনছেন কোম্পানী মালিকরা। এলাকার কর্মক্ষম লোকেরা আগে যেখানে ঘুরে বেড়াতো কাজের সন্ধানে এখন তারা দল বেঁধে কাজ করছে এসব কোম্পানিতে। সব মিলিয়ে এক সময়ের নিস্তব্দ পল্লীগুলো যেন এখন পরিণত হচ্ছে শিল্পনগরীতে।
এএজেড