সমাবেশকে ঘিরে চাঙ্গা সিলেট বিএনপি, কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ
বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সিলেটে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। পক্ষান্তরে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কোন্দলে ক্রমেই বিপর্যস্ত আওয়ামী পরিবার। দলের মহানগর শাখায় ১৩টি ওয়ার্ডে সম্মেলন শেষে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিভক্তি, অনৈক্য এবং অনিয়মের বিষয়টি এখন ভাবিয়ে তুলেছে কেন্দ্রকে। এই অবস্থা শুধু মহানগর আওয়ামী লীগেই নয়। জেলা কমিটির আওতাধীন সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিও গঠনতন্ত্র না মেনে করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি মাসের ২ নভেম্বর জেলা ও মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষে ঘোষিত আংশিক কমিটি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে নেতা-কর্মীদের মাঝেও। বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের (একাংশ) অভিযোগ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও পৌঁছে গেছে। সম্মেলন পরবর্তী যুব মহিলা লীগের অবস্থাও একই। সব মিলিয়ে অনৈক্য, বিভাজন আর অন্তর্দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত সিলেট আওয়ামী পরিবার।
এদিকে ১৯ নভেম্বর সম্মেলনকে সামনে রেখে সহযোগী সংগঠন গুলোকে নিয়ে গণসংযোগে ব্যস্ত রয়েছে বিএনপি। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে সর্বত্র। সিলেট সরকারি আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে প্রস্তুত হচ্ছে ৬০ ফুটের দীর্ঘ মঞ্চ। প্রতিদিন গণসংযোগ শেষে নেতা-কর্মীরা মঞ্চ নির্মাণের কাজ তদারকি ও নির্দেশনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীরা বলছেন, এই সমাবেশ হবে সিলেটে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির বলেন, ১৯ নভেম্বর পুরো সিলেট নগর জনসমুদ্রে পরিণত হবে। বিএনপির প্রত্যেক নেতা-কর্মীর লক্ষ্য হচ্ছে ১৯ নভেম্বরের বিভাগীয় জনসমাবেশ সফল করা। কোনও বাধা-বিপত্তিতে জনজোয়ার ঠেকানো যাবে না।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন আমাদের সমাবেশ আয়োজনে সহযোগিতা করবে বলে মনে করছি। সমাবেশ সফল করতে সব রাজনৈতিক দল ও পুলিশের সহযোগিতা চাই আমরা। তবে বাধা-বিপত্তি এলেও জনসমাগম ঠেকানো যাবে না।’
গণসমাবেশ নিয়ে বিএনপি যখন মাঠ দখলের পরিকল্পনায় তখন সিলেট আওয়ামী লীগে সুখবর নেই। বরং দলীয় কোন্দল মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে দিন দিন। এই অবস্থায় গত ৬ নভেম্বর সিলেট সফর করে গেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা। তবে বিক্ষোভ থামেনি নেতা-কর্মীদের। সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও সিলেট আওয়ামী লীগের অনৈক্য, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কোন্দলের নানা তথ্য উঠে আসে। এরই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তলব করেন সিলেটের ৪ নেতাকে। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতার সঙ্গে মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) গণভবনে বৈঠক করেন দলীয় সভানেত্রী। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ১০ অক্টোবর। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, সেখানে ভোট ছাড়াই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ওয়ার্ড সেক্রেটারি করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। এক পর্যায়ে নেতা-কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে সম্মেলন স্থলে ভাঙচুর শুরু করেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান জাকির। পরে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ওই ওয়ার্ডে কমিটি স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সম্মেলনেও। এ ব্যাপারে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বশেষ কমিটির সহ-সভাপতি সৈয়দ আতিকুর রব চৌধুরী জুয়েল সংবাদ সম্মেলন করে নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেন। এ সময় অভিযোগ করা হয়, ‘নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে’ জাকির ‘পকেট কমিটি’ গঠন করছেন। ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে জাকিরের উপর আরো অনেকের ক্ষোভ আছে বলে জানা গেছে।
কোন্দলের বাহিরে নেই জেলা আওয়ামী লীগও। জেলার আওতাধীন সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনতন্ত্র না মেনে করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ২৫ অক্টোবর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ করেন।
এ প্রসঙ্গে সদর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আমির উদ্দিন বলেন, ‘বিতর্কিত ব্যক্তিকে দিয়ে রাতের আঁধারে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সেই হিরণ মিয়া বিএনপির রাজনীতি করতেন। তিনি যুক্তরাজ্যে বিএনপির পদ বিদারী নেতা ছিলেন।’
ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবি জানান তারা। এ ঘটনায় কমিটির পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল বের করা হয় একই সময়ে। পরে তেমুখী পয়েন্ট এলাকায় উভয়পক্ষ মুখোমুখি হয়। তবে পুলিশ মাঝখানে ব্যারিকেড দিয়ে উভয়পক্ষকে সরিয়ে দেয়।
এ ছাড়াও গত ২ নভেম্বর সিলেট জেলা ও মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জেলা ও মহানগরে আংশিক কমিটির নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ করতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। বিক্ষুব্ধদের দাবি, জেলার ১৩টি ইউনিটের মধ্যে ৯টি উপজেলার সভাপতি-সম্পাদক উপস্থিত থাকার পরও তাদের কোনো মতামত না নিয়েই অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও আর্থিক সুবিধা পেয়ে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে বলেও দাবি বিক্ষুব্ধ অংশের। একইসঙ্গে জেলা কমিটিতে ঘোষিত সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা বাছিত ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই গ্রীন কার্ডধারী বলেও জানান তারা।
তা ছাড়াও ৮ নভেম্বর সিলেট মহানগর যুব মহিলা লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে সুফিয়া ইকবাল খানকে সভাপতি ও ইঞ্জিনিয়ার মরিয়ম পারভীনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। একই দিনে অনুষ্ঠিত হয় জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলন। এই সম্মেলনে নাজিরা বেগম শীলাকে সভাপতি ও ডা.দীনা বেগমকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হলে শুরু হয় প্রকাশ্যে বিক্ষোভ। ক্ষোভের মুখে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা সভা স্থল ত্যাগ করে চলে যান। এ বিষয় নিয়ে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের খেদোক্তি এখনও চলছে।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার মিনু বলেন, ‘সম্মেলনের বিষয়টি আমাকে
জানাননি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা কিংবা এ বিষয়ে আমার কোনো মতামতও চাওয়া হয়নি।’
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি বিলকিছ নূর বলেন, ‘এটিকে সম্মেলন বলা হলে দলকে বিতর্কিত করা হবে। কারণ সম্মেলনে ঘোষিত কমিটিতে আর্থিক শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সরব আন্দোলন।’
তিনি আরও বলেন, এই সম্মেলন পুরোটাই হাস্যকর, অগণতান্ত্রিক ও দলীয় গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।
এসব ব্যাপারে সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, দলের সাংগঠনিক বিষয়ে মঙ্গলবার সিলেটের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলেন দলীয় সভানেত্রী। সামনে জাতীয় সম্মেলনের আগেই দলীয় বিভাজন নিরসন করতে চায় আওয়ামী লীগ। সাংগঠনিক গতিশীলতার লক্ষ্যে এই বৈঠক আহ্বান করা হয়।
এসআইএইচ