‘ফাঁস দিতে গিয়ে রশিতে ভেসে উঠে মায়ের মুখ’
‘সালটি ঠিক মনে নেই। তবে করোনাকালের বছরখানেক আগের ঘটনা। ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির মুখে নিজেকে দাঁড়াতে গিয়েও চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। হতাশা আর একাকীত্বের কাছে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে উপহাস বলে মনে হতো। তারপর ঘরের মধ্যে থেকে ফাঁস নিতে রশি প্রস্তুত করি। কিন্তু যখনই ফাঁস নিতে যাব, রশিতে ভেসে উঠে মায়ের মুখ। এ ঘটনা একবার নয়, দুইবার ফাঁস নিতে গেলে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারপর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মনে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করি। এক সময় নিজেই আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির কাজে বাইসাইকেল সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।’ এই কথাগুলো বলছিলেন পর পর দুই বার আত্মহত্যা করতে গিয়েও ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার গাইঘাটার গুটরি গ্রামের সঞ্জয় বিশ্বাস।
জানা গেছে, সঞ্জয় বিশ্বাস অন্য যুবকদের মতোই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। নিজ উদ্যোগে একটি ফাস্ট ফুডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রথম প্রথম ব্যবসায়ে বেশ সাড়া পাওয়া গেলেও এক সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই পরিস্থিতি সঞ্জয়কে কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। তারপর সর্বনাশা ভয়াল করোনাকাল। ব্যবসায়ীক অবস্থা তখন দাঁড়ায় আরও ভয়াবহরূপে। অবশেষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। আর তখনই ভর করে একাকিত্ব। কমে যায় বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা। নি:সঙ্গ জীবনযাপন সঞ্জয়কে তিলে তিলে দগ্ধ করতে থাকে। এক সময় আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। যখনই ফাঁস নিতে যান তখনই রশিতে ভেসে উঠে তার মায়ের মুখ। তারপর থেকেই তার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা শুরু হয়। সেই সঞ্জয় আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে বাইসাইকেলে চড়ে ভারতের ২৪টি রাজ্য ঘুরার পর এখন বাংলাদেশে এসেছে। বুধবার (২৬ সেপ্টেম্বর) যশোরের বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর বিভিন্ন জেলা সফরের অংশ হিসেবে এখন তিনি সিলেট শহরে।
নিজের মধ্যে এই পজেটিভ চিন্তার বীজ বপন করার জন্য নিজের এক প্রতিবেশী বন্ধুর স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান সঞ্জয় বিশ্বাস। মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ঢাকাপ্রকাশের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, সেদিন ওই ভদ্র মহিলার কথায় মানসিক প্রশান্তির জন্য বাইসাইকেল সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ঘুরতে যাই। এর ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। পারিবারিক সাপোর্টের পাশাপাশি মানসিকভাবেও প্রশান্তি লাভ করি। একদিন বাইসাইকেল দিয়ে ২৩ কিলোমিটার যাত্রার পর আমি নিজেকে নতুনভাবে আবিস্কার করতে সক্ষম হই। ২০২১ সালের ৩০ আগষ্ট বাইসাইকেল নিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ পর্ব। এরপর ভারতের ২৪টি রাজ্য সফর শেষে ২০২২ সালের ২৪ মে বাড়ি ফিরি। মানুষ এবং সংবাদ মাধ্যমের সাপোর্ট পেয়ে ‘আত্মহত্যা যন্ত্রণা কম করে না, যন্ত্রণা অন্য কাউকে দিয়ে যায়’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে শুরু করি আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রচারণা।
সঞ্জয় বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা সফর শেষে সিলেট বিভাগে আছি। শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত যাত্রা শেষ করেছি।
বাংলাদেশ সফরে অভিজ্ঞতা কিংবা এই যাত্রায় কোনো দুর্ভোগ, অসহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে সঞ্জয় বলেন, এই দেশের মানুষ খুবই আন্তরিক। ফলে পথের ক্লান্তি থাকলেও দুর্ভোগের ছোঁয়া নেই। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই বেশ সাড়া পাচ্ছি। আর নির্বিঘ্ন যাত্রাপথে সাইকেলিস্টদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
সিলেটের বিষয়ে সঞ্জয় বলেন, এই শহরের মানুষ খুবই অতিথিবৎসল। বিশেষ করে সিলেটে দুই সাইকেলিস্ট শাকিল এবং অত্রি আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে সার্বক্ষণিক। জীবন পাল নামের অপর এক বন্ধু নিজের এখানে থাকতে দিয়েছে।
সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, প্রচারণা করতে গিয়ে একটি বিষয় খুবই খেয়াল করেছি যে মানুষ আমার চাইতে আরও বেশি হারিয়েছে। তাদের দু:খ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা আরও বেশি। শুধুমাত্র ভালো কনসালটেন্সির অভাব আছে। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে- বিলম্বিত সিদ্ধান্ত বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তাই আগে ঠিক করতে হবে, আমি মারা যাওয়ার অর্থ শুধু একজনের বিদায় নয়। এর সাথে পরিবার, পরিবেশ, সমাজ সবকিছুতেই ক্ষত সৃষ্টি হবে। সুতরাং আমাকে আগে বাঁচাতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তখনই পরিবার, সমাজ, পরিবেশ সবকিছুতেই সুপ্রভাব বিস্তৃত হবে।
এসআইএইচ