জঙ্গির গুলিতে নিহত সেনা কর্মকর্তার দাফন সম্পন্ন
বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে কেএনএফের গুলিতে নিহত মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রংপুরে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সকাল ১১টায় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে রংপুর সেনানিবাসে তাঁর মরদেহ আনা হয়। এরপর বেলা সাড়ে ১২টায় নগরীর মর্ডাণ কোর্টপাড়াস্থ নিজ বাড়িতে সেনা সদস্যরা ঘাড়ে করে কফিনে সেনা কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে আনেন।
এ সময় তাঁর মরদেহ একনজর দেখতে এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনদের ঢল নামে। বাদ যোহর বাড়ির সামনে গাছ বাগানে নাজিম উদ্দিনের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়ে। শত শত মানুষ জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করেন। এরপর সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাড়ির পার্শ্বে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। লাশ দাফন ও দোয়া শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করেন সেনা সদস্যরা।
কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) অতর্কিত গুলিবর্ষণে নিহত সেনা সদস্য মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসতে চাওয়া নাজিম উদ্দিন যে নিথর দেহে বাড়ি ফিরবেন কেউ ভাবতেই পারেনি। তার এমন মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যদের সাথে গ্রামবাসীও শোকে মুহ্যমান। সোমবার দুপুরে রংপুর সদরের ঘাঘটপাড়ায় নাজিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের আহাজারি। কাঁদতে কাঁদতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া স্ত্রী ও দুই সন্তান হয়ে পড়ছেন অচেতন।
মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন বিগত ৩০ বছর ধরে অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি রংপুর সদর উপজেলার ঘাঘটপাড়া গ্রামের মৃত শমসের আলীর ছেলে। নাজিম উদ্দিনরা দুই ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে নাজিম উদ্দিন ছিলেন সবার বড়।
মৃত ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের সাথে স্ত্রী চামেলি বেগমের সবশেষ কথা হয়েছিল শনিবার দুপুরে। পরদিন রোববার (১৩ মার্চ) বিকেলে আসে স্বামীর মৃত্যুর খবর। চামেলির সবকিছুই ছেয়ে গেছে ঘোর অন্ধকারে। নিজের কথা না হয় বাদই থাকলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড় সন্তান নায়েমুজ্জামান চঞ্চল এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছেলে আব্দুল্লাহ আল নোমান নীরবের ভবিষ্যত নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
সে ভাবনা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে চামেলিকে স্বজনরাও নির্বাক।নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী চামেলি বেগম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলতে পারছিলেন না।শুধু হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। স্বজনরা তাকে সান্তনা দিলেও নিজেকে সামলে নিতে পারছিলেন না চামেলি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি সব স্বপ্ন তো ভেঙে গেল। এখন ছেলে দুটোকে কিভাবে পড়ালেখা করাব কি হবে আমাদের? কেন আল্লাহ আমার স্বামীকে এভাবে কেড়ে নিলো। সরকারের কাছে চাওয়া আমার সন্তানদের যেন দায়িত্ব নেন।
নাজিম উদ্দিনের ছোট ভাই আজিম উদ্দিন বলেন, আমার ভাই একজন সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি গ্রামের সকলের সাথে ভাল আচারণ করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই আমাদের বাবার স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। বাবার কমতি বুঝতে দেননি। আমরা সেই বড় ভাইকে হারিয়ে আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছি। পরপারে মহান আল্লাহ আমার বড় ভাইকে ভাল রাখবেন এই দোয়া করছি।
রংপুর সিটি করর্পোরেশনের মেয়র মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, দেশের জন্য নাজিম উদ্দিনের এই আত্মত্যাগকে শহীদি মৃত্যু বলে মনে করেন। তিনি চান নাজিমের পরিবারের পাশে এগিয়ে আসবে সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিশেষ ভাবে অনুরোধ যেন নিহত নাজিম উদ্দিনের সন্তানদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সঙ্গে এতিম এ পরিবারকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি সরকারের নিশ্চিত করা উচিত। কারণ নাজিম উদ্দিনের এই মৃত্যু দেশের জন্য।
এদিকে সোমবার সকালে হেলিকপ্টারযোগে নাজিম উদ্দিনের মরদেহ প্রথমে রংপুর সেনানিবাসে আনা হয়। সেখানে অনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার মরদেহ ঘাঘটপাড়া গ্রামে নেয়া হয়। বাদ যোহর সোয়া দুইটার দিকে সেখানকার বাগানবাড়িতে জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এসময় সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মাহবুব আলম সহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, রবিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে বান্দরবনের রুয়াংছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামের একটি সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী দল সেনা সদস্যদের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান নাজিম উদ্দিন। আহত দুই সেনা সদস্য বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আইএসপিআর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে জাতীয় শিশু দিবস ও মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মা ও শিশুদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের উদ্দেশে গমন করা দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন সেনা সদস্যরা। তাদের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে কেএনএ দলের সন্ত্রাসীরা।
রংপুর সেনানিবাসের সেনা কর্মকর্তা লেঃ কর্ণেল মাহবুব বলেন, আমরা তার জীবন থেকে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের শিক্ষা নেব। সেই সাথে শহীদ মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিনের পরিবার ও তার সন্তানদের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বদা পাশে থাকবে সেনাবাহিনী।
এএজেড