দূর্গম চরে আশার আলো একটি উচ্চ বিদ্যালয়
ব্রহ্মপুত্র নদেরবুকে দূর্গম চরাঞ্চলের ভগবতীপুর। দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের এই দূর্গম চরাঞ্চলে প্রায় ৫০০ পরিবার বসবাস করছে। এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তিনটি মাদ্রাসা রয়েছে কিন্তু ছিলো না কোন উচ্চ বিদ্যালয়। তাই প্রাথমিক পাসের পর এই চরের শিক্ষার্থীদের আর পড়াশুনা হতো না।
জেলা প্রশাসনেসর উদ্দ্যোগে এই চরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়। চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্য্যক্রম চালু করা হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন ১৩০ জন শিক্ষার্থী। চারজন শিক্ষক পাঠদান করছেন। চরের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আশার আলো জাগিয়েছে এই বিদ্যালয়টি।
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রে নদেরবুকে প্রায় ৪০০ চর রয়েছে। প্রত্যেক চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা রয়েছে। এতগুলো চরের মধ্যে মাত্র ৬টি চরে ৬টি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্দ্যোগে ৭ম উচ্চ বিদ্যারয়টি প্রতিষ্ঠা হলো চর ভগবতীপুরে। অধিকাংশ চরে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি।
চর পার্বতীপুর এলাকার কৃষক আজগর আলী (৫০) বলেন, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। প্রাথমিক পাস করার কিছুদিন পর মেয়ে দুটির বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে প্রাথমিক পাস করার পর তার সঙ্গে খেতে কাজ করছে। ছোট ছেলে গেল বছর প্রাথমিক পাস করেছে। চরে নতুনভাএব গড়ে ওঠা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করেছেন।
তিনি বলেন, চরে উচ্চ বিদ্যালয়টি গড়ে না উঠলে হয়তো ছোট ছেলের পড়াশুনারও ইতি ঘটতো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছোট ছেলে কলেজ পযর্ন্ত পড়াশুনা করাবো। আগে যদি আমাদের চের উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে উঠতো তাহলে আমার বাকি তিনে ছেলে-মেয়ে কলেজে পড়াশুনা করার সুযোগ পেতো।
এই চরের কৃষক নয়া মিয়া (৫৭) বলেন, চর থেকে মুল-ভূখন্ডে গিয়ে পড়াশুনা করা তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য কষ্টকর। এছাড়া এটা ব্যয় বহুলও। তাই তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক পযর্ন্ত পড়াশুনা করে আর পড়াশুনা করতো না। আমাদের চরে নতুন একটি উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে। এটা আমাদের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে। এখন আমাদের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
৬ষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থী কোহিনুর আক্তার ও সুমি খাতুন বলেন, চরে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা না হলে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেতো। আমি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। এখন আমি উচ্চ শিক্ষা লাভের স্বপ্ন দেখছি। আমার বাবা-মাও আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করতে আগ্রহী, কোহিনুর বলেন। চরে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ না থাকায় আমার দুইজন বড় বোনের বাল্য বিয়ে হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোজিনা আক্তার জানান, মুল-ভূখন্ডে যাত্রাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা দূর্গম হওয়ায় তিনি সপ্তাহে একদিন বিদ্যালয়ে যেতেন। তাদের চরে বিদ্যালয় গড়ে উঠায় তিনি এখানে ভর্তি হয়েছেন। “এখন আমি নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসি। এখন আমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি, তিনি বলেন।
বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির আজীবন সদস্য ইউসুফ আলমগীর জানান চর ভগবতীপুর ছাড়া চর পার্বতী, পোড়ার চর, মাঝের চরসহ বিভিন্ন চরের শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীই বেশি। চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াতে ভূমিকা রাখবে।
বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান কার্য্যক্রম পরিচালিত করতে আমরা নজর রাখছি এবং নজরদারি অব্যাহত থাকবে, তিনি বলেন। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমরা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে চারটি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। ধিরেধিরে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে জানান তিনি।
স্কুলের শিক্ষক ফারুক আহমেদ জানান, তারা স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠদান করছেন। চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালাতে তারা নিবেদিত রয়েছেন। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জায়গা সংকুলান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবকাঠামো আরো বাড়ানো দরকার। ”আমরা চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বলেন, তিনি বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাঠদানের অনুমতির জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। পাঠদানের অনুমতি পেলে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। বিদ্যালয়টি যাতে দ্রুত এমপিওভুক্ত করা যায় সেব্যাপারে আমরা চেষ্টা করবো।
চর ভগবতীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো: রাসেদুল হাসান জানান, সরকারি আর্থিক সহায়তায় বিদ্যালয়টির জন্য ৪টি রুমে চর উপযোগি একটি টিনসেড ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানী এবং বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি আর্থিক তহবিল গঠন করা হয়েছে।
এমপি, জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, কুড়িগ্রাম পৌরসভার মেয়রসহ স্থানীয় অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সমাজের সকলের পৃষ্টপোষকতা পেলে স্কুলটি আরও বিকশিত হবে। বিদ্যালয়টি চরাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে।
এএজেড