সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়েও সংসার চলে খেয়ে না খেয়ে!
নির্বাচিত হয়েও নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগম (৪০)। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েও গত এক বছর দেড় মাসেও নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটনাতে পারেনি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগম। বর্তমানে একজন মহিলা সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি স্বামী-শ্বাশুড়ীসহ দুই সন্তানকে নিয়ে অতি কষ্টে খেয়ে না খেয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। ওই মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগমের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের নগরাজপুর ৫নং ওয়ার্ডে। তিনি ওই ওয়ার্ডের খলিল মিয়ার স্ত্রী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের বাড়ীতে বৃদ্ধা শ্বাশুড়ী-স্বামী খলিল মিয়া ও দুই সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের সংসার চলে অতি কষ্টে। তার স্বামী খলিল মিয়ার নেই কোন ফসলি জমি। মাত্র ৩ শতক জমিতে জরাজির্ণ দুইটি টিনসেটের ছাপড়া। একটিতে থাকেন তিনি ও অন্যটিতে থাকেন তার স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলে। বড় ছেলে আনিচুর রহমান দশম ও ছোট ছেলে আরিফুল ইসলাম ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়েন। জরার্জিণ টিনসেটের ছাপড়ায় দুই ছেলের নেই পড়ার একটি টেবিলও।
বড় ছেলে আনিচুর কোন রকমেই বাঁশ দিয়ে একটি টেবিলে তৈরী করে বই রাখেন। সেখানেই গাঁদাগাদি ভাবে দুই ভাই পড়াশুনা করেন। নেই রান্না করার ঘরও। দুই টিনের ছাপড়ার এক কোণায় ছনের ধাঁপরীর মধ্যে কোন রকম রান্না-বান্না করেন আর্জিনা বেগম। আর্জিনা বেগমের সম্ভল বলতে সম্মানী ভাতা ৩ হাজার ৬০০ টাকা। সংসারে রয়েছে তিনটি মুরগী ও চারটি হাঁস। অতিকষ্টে দু-বেলা দু-মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করছেন আর্জিনা বেগম ও তার স্বামী খলিল মিয়া।
তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে অন্য জনপ্রতিনিধিদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও আর্জিনা বেগমের এক বছর অতিক্রম করলেও নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি তিনি। গত এক বছর এক মাসে পরিষদ থেকে সম্মানি ভাতা ছাড়া যতগুলো বরাদ্দ পেয়েছেন তার সব গুলোই জনগণের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। ফলে একজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হয়েও এক বছর এক মাস পেরিয়ে গেলেও নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটনাতে পারেনি। ফলে বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীসহ স্বামী-ও দুই সন্তানকে নিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন আর্জিনা বেগম।
প্রতিবেশি আবু আলী ও রব্বানী মিয়া জানান, মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগম ও তার স্বামী খুবেই ভাল মানুষ। আর্জিনার স্বামী খলিল মিয়া এক টানা তিন বার ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করেছে। এক বারও জিততে পারেনি। যেটুকু সম্পদ ছিল তা নির্বাচন করেই শেষ করেছেন তিনি। তিনি নিজের স্বপ্ন পুরুণ করতে না পারলেও হাল ছাড়েননি।
পরে তিনি তার স্বপ্ন পুরণের লক্ষ্যে স্ত্রী আর্জিনা বেগমকে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসাবে নির্বাচনে দাড় করিয়ে দেন। প্রথম বার পরাজিত হলেও দ্বিতীয় বার তার স্ত্রী আর্জিনা বেগম সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। স্বামী-স্ত্রী দুই জনই জনগনের সেবায় নিয়োজিত। তিন ওয়ার্ড বাসীও উন্নয়ণে জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করেই যাচ্ছেন।
প্রতিবেশি আরও জানান, আর্জিনা বেগম নির্বাচিত হওয়ার এক বছর এক মাসেও তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। একজন মহিলা সদস্য হয়েও জরার্জিণ দুইটি টিনের ছাপড়ায় কোন রকমেই স্বামী, শ্বাশুড়ীসহ দুই সন্তানকে দুর্ভিসহ জীবন-যাপন করলেও সরকারি কোন অনুদান আসলে কোন টাকা-পয়সা ছাড়াই জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেন।
আমরা লোক মূখে শুনি অনেক জনপ্রতিনিধি নাকি ৪০ দিনের কর্মসূচির দুই একটা করে নিজের নামে থাকে। কিন্ত আর্জিনা বেগম শত কষ্টে থাকলেও সেই ৪০ দিনের কর্মসূচিতে তার স্বামীর নামটিও রাখেনি। তিনি এতো দিনে যা পেয়েছে তা সব কিছুই জনগণের মাঝে দিয়েছেন। আমরা তার কালের স্বাক্ষী।
আর্জিনা বেগমের স্বামী খলিল মিয়া জানান, আমার সংসারে হাল খুবই নাজুক। আমার দেড় বিঘা জমি ছিল। আমি তিন বার ও আমার স্ত্রী দুই বার নির্বাচন করায় দেড় বিঘা জমি বিক্রি করেছি। এখন মাত্র তিন শতক জমিতে জরাজির্ণ দুইটি টিনের ছাপড়ায় কোন রকমেইস্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সববাস করছি। স্ত্রীর সম্মানী দিয়েই খেয়ে না খেয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছি।
তিনি আরও জানান, সরকারী বরাদ্দকৃত অনুদান গরীবের মাঝেই বিলিয়ে দিচ্ছি। কোন বিনিময় নয়। সরকার যদি আমার স্ত্রীকে বড় ধরণের কোন বরাদ্দ দেয় সেই বরাদ্দ মোতাবেক কাজ করে যদি দুইটা টাকা ঘরে আসলে আসবে, না আসলে না আসবে, কোন দুঃখ নেই। দোয়া করবেন শতশত কষ্টের মাঝেও জনগণের সেবা করে চলতে পারি।
সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগম জানান, আমার স্বামী নির্বাচন পাগল। তার স্বপ্ন ছিল সে নির্বাচনে জিতে জনগণের সেবা করবে। টানা তিন বার নির্বাচন করে হেরে যাওয়ায় তার স্বপ্ন পুরণ না হওয়ায় তিনি আমাকে দিয়ে নির্বাচন করান। আমি প্রথম বার হেরে গেলেও দ্বিতীয় বারে আল্লাহের অশেষ কৃপায় জয়লাভ করি। টানা পাঁচ বার নির্বাচন করায় আমার স্বামীর দেড় বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখনো অনেক পাওনাদার আছে।
নির্বাচনে জয়লাভ করার এক বছর দেড় মাস অতিবাহিত হলেও আমার ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। এখনো ৭০ হাজার টাকা মানুষ পাবে। জনগণের সেবার পাশাপাশি আমি কোন রকমেই জরাজির্ণ ছাপড়ায় স্বামী-শ্বাশুড়ী ও দুই সন্তানকে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই। স্থানীয় সরকার যদি আমাকে বড় ধরণের বরাদ্দ দেন, তাহলে হয়তো বরাদ্দের আলোকে কাজ-কাম করে দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ অভাবী পাঁচ সদস্যের সংসারে একটু স্বস্তি আসবে।
তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন আমি ও আমার স্বামী কেমন মানুষ এলাকায় ভাল করে খোঁখ নেন। উত্তর পেয়ে যাবেন ভাই। রামরামসেন ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু মুসা জানান, আর্জিনা বেগমের স্বামী নির্বাচনের পিছনে সব কিছুই শেষ করেছে। তিনি টানা তিনবার ও তার স্ত্রী আর্জিনা দ্বিতীয় বারে নির্বাচিত হয়েছেন।
আমার জানা মতে আর্জিনা ও খলিলের কোন আবাদী জমি নেই। মাত্র তিন শতক জমিতে জরাজির্ণ দুইটি টিনসেটের
ছাপড়ায় কোন রমকেই বসবাস করছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত সরকারি অনুদানসহ যা কিছু পেয়েছেন তার সব টুকুই আর্জিনা ও তার স্বামী জনগণের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন।
ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যার মোহাম্মদ আলী শেখ জানান, আসলেই আর্জিনা বেগমের অবস্থা খুবই করুণ। একটা থাকার ঘরও নেই। পরিষষের সদস্য হওয়ায় সরকারী ঘরও দেওয়ার ক্যাটাগড়িতে পড়ে না। তার সংসারও চলছে কোন রকমেই। তবে তাকে সহায়তা করার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জানান, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আর্জিনা বেগমের ব্যাপারে খোঁচ খবর নেয়া হবে। একজন দরিদ্র পরিবার থেকে যদি তিনি নি:স্বার্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করে থাকেন তাহলে তাকে সরকারি ভাবে সহায়তার করার আশ্বাস দেন ইউএনও।
এএজেড