এইচএসসি পাস করেও ভালো নেই বিএসএফের গুলিতে দৃষ্টি হারানো রাসেল
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এর গুলিতে ডান চোখের দৃষ্টি হারানো সেই বাংলাদেশি স্কুলছাত্র রাসেল মিয়া এবার এইচএসসি পাস করেছে। শিক্ষার্থী রাসেল ও তার পরিবারের দাবি ডান চোখের দৃষ্টি হারানোর পাশাপাশি সব সময় ডান চোখ ও মাথা ব্যাথার কারণে সে দীর্ঘক্ষণ পড়াশুনা করতে না পাড়ায় এসএসসি ও এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট করতে পারেনি।
দৃষ্টি হারানো রাসেল ২০২০ সালে বালারহাট আদর্শ স্কুল কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ- ৩.১৭ পয়েন্ট ও এবছর এইচএসসিতে একই প্রতিষ্ঠান থেকে জিপিএ-৩.৭৫ পয়েন্ট পেয়েছেন। এর আগে রাসেল চোখের দৃষ্টি হারানোর আগে ২০১৭ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসিতে জিপিএ-৪.৭৯ পেয়েছেন। রাসেল মিয়ার বাড়ী দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তঘেষা বালাতাড়ি গ্রামে। রাসেল ওই গ্রামের দিনমজুর হানিফ উদ্দিনের ছোট ছেলে।
দৃষ্টি হারানো শিক্ষার্থী রাসেল মিয়া জানান, ডান চোখের তীব্র ব্যাথা ও বাম চোখের আলো দিয়ে কোন রকমেই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। চোখ ও মাথার তীব্র ব্যাথার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশুনা ও লেখালেখি করলে মাথার ব্যাথা আরো তীব্র আকার ধারণ করে। তাই দীর্ঘক্ষণ পড়াশুনা করতে পারিনা। চরম ঝঁকি নিয়ে কষ্ট সহ্য করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
আমার বন্ধু-বান্ধবরা ভাল রেজাল্ট করলেও আমি ভাল রেজাল্ট করতে পারিনি। তাই কোন রকমেই পাশ করেছি মাত্র। চোখের তীব্র ব্যাথার কারণে আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেলো। এখনো বিএসএফের ছোঁড়া রাবার বুলেটের পিলেট স্প্রিন্টার আমার ডান চোখ ও মূখ মন্ডলে আছে। সব সময় ব্যাথা করে। আমার খুবই খারাপ লাগে। আমি সামনের দিনগুলো কিভাবে সামাল দিবো জানি না।
রাসেল আরও জানান,যেহেতু বিএসএফের গুলিতে আমার ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছি। এখনো তাই শেষবারের মতো যেন ভারত সরকার একবার ভারতে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ করে দেয় বলে কান্নাজড়িত কন্ঠে জোড়দাবী জানান দৃষ্টি হারানো রাসেল।
রাসেলের ভাই রুবেল মিয়া জানান, ভারতীয় বিএসএফের ছোঁড়া রাবার বুলেটের স্প্রিন্টের আঘাতে গুরুতর আহত হয় আমার ছোট ভাই রাসেল মিয়া। সেই দিন প্রথমেই ফুলবাড়ী হাসপাতাল ও পরে রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজ ও হাতপাতাল এবং সর্বশেষ দীর্ঘ এক মাস ঢাকা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় রাসেল মিয়া।
রাসেল থাকা অবস্থায় বিএসএফের ছোঁড়া রাবার বুলেটের স্প্রিন্টের আঘাতে গুরুতর আহতের খবর গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশিত হলে আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) আহত স্কুল ছাত্র রাসেলের খবর নিতে ঢাকা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট হাসপাতালে ছুটে যান।
পরে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আইন ও শালিস কেন্দ্রের কর্মকর্তা আবু আহাম্মেদ ছাইজুল কবির ও হাসিবুর রহমান ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশন গিয়ে দৃষ্টি হারানো রাসেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য আবেদন করেন। আবেদন করায় রাসেলের ভারতের উন্নত চিকিৎসার জন্য তার পরিবারকে আশ্বাস প্রদান করেন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশন।
সেই আবেদনের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ২৮ জুলাই বিকভল ৩ টা ১৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ভারতীয় এয়ারওয়েজে দিল্লীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন রাসেল ও তার সব বড় ভাই রেজাউল ইসলাম। এরপর ৩০ জুলাই নিউ দিল্লীর হাসপাতালে রাসেলের চিকিৎসা শুরু হয়। হাসপাতালের ডাক্তার প্রদীপ কুমার ও সুনীল কুমারের তর্ত্তাবনে নয় দিন চিকিৎসার করেও আহত স্কুলছাত্রের ডান চোখের আলো ফেরাতে পারেনি।
রুবেল মিয়া আরও জানান, প্রথম দফায় ভারতে নয় দিন ও দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারী দিল্লীর একই হাসপাতালে দুই দিন উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আসলেও কোন দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি। রাসেলের ডান চোখে দুইটা, বাম চোখে একটাসহ মাথা, কান,ও সমস্ত মূখমন্ডলে এখনো ৪৮ টি পিলেট স্প্রিন্টার রয়েছে। যা অত্যান্ত যন্ত্রণাদায়ক। শুধু ভারতে নং বাংলাদেশেও এখনো তার চিকিৎসা অব্যাহত আছে। একটু ব্যাথা হলেই ডাক্তার দেখাতে হয়।
তার চিকিৎসার জন্য জমি বন্ধকসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে প্রায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখনো যাচ্ছে। রাসেলের ইচ্ছা অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসায় যদি তার ডান চোখ অপেরাশন করে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে জরুরী ভিত্তিতে শেষ বারের মতো ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে।
রাসেলের বাবা হানিফ উদ্দিন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে আমার ছেলের ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে। জীবন অন্ধ করে দিয়েছেন। চোখের তীব্র ব্যাথার কারণে বেশিক্ষণ পড়াশুনা করতে পারে না। তাই কোন রকমে পড়াশুনা করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে পারেনি।
রাসেলের বাবা আরও জানান শেষবারের মতই আর একটা বার ভারতে চিকিৎসার জন্য ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশনাসহ ভারত সরকারের কাছে আমার জোড় দাবী জানাচ্ছি। সেই সাথে রাসেলের ভবিষ্যতের জন্য একটা সরকারি চাকুরির দাবী জানিয়েছেন তিনি।
আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহাম্মেদ ছাইজুল কবির জানান, গণমাধ্যমে রাসেলের প্রতিবেদন দেখে আমরা তার সু-চিকিৎসার জন্য তৎকালীন সময়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশনারে যোগযোগ করি।
পরে রাসেলের ভাই রুবেলসহ ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশনার শ্রিংলা বরাবর আবেদন করলে তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ায় ঐ সময় আহত রাসেলকে দুই দুই বার উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তবে রাসেলের জন্য আমাদেরও কষ্ট লাগে। সেই সাথে বর্তমান ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই-কমিশনারকে রাসেলের সু-চিকিৎসার জন্য বিষয়টি জানানো হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য,গত ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিকালে ফুলবাড়ী উপজেলার গোড়কমন্ডল সীমান্তে আন্তর্জাতিক মেইন সীমানা পিলার ৯৩০/৮ এর পাশে বাংলাদেশের ২০ গজ অভ্যন্তরে রাসেল বন্ধুদের সঙ্গে গরুর ঘাস কাটতে গেলে ৩৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ সদস্য তাদেরকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
এতে অন্যরা অক্ষত থাকলেও স্কুলছাত্র রাসেলের মুখমন্ডলে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ফুলবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রাইম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় চক্ষু, বিজ্ঞান ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এএজেড