তৃণমূলের রাজনীতি: ঠাকুরগাঁও-৪
একযুগ ধরে জামায়াতের অফিস সীলগালা!
ঠাকুরগাঁওয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূলের রাজনীতিতে নিজ নিজ ঘর গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজনৈতিক দলগুলো। জেলা আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা সম্মেলন প্রায় শেষের দিকে। জেলার তিনটি আসনেই এবার দখলে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
পাশাপাশি দেড়যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিও তাদের শক্তির মহড়া দিতে ওয়ার্ড, উপজেলা ও জেলা সম্মেলন করছে। হামলা-মামলা যতই হোক নেতা-কর্মীরা রাজপথে নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও তাদের শক্তির জানান দিতে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে।
চতুর্থ পর্ব
ঠাকুরগাঁও জেলা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী মোহাম্মদ আলমগীর বলেছেন, বর্তমানে দেশের প্রেক্ষাপট ভয়াবহের দিকে এগুচ্ছে। গ্যাস বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমুল্যর উর্দ্ধগতিতে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বাজারে গিয়ে তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। প্রশাসনের দমন-নিপীড়নের কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছি না।
জামায়াতে ইসলাম যাতে কোন রাজনীতি কর্মসূচি করতে না পারে সে জন্য ১২/১৩ বছরে ধরে সরকার আমাদের নেতাকর্মীদের উপর জুলুম, নির্যাতন, হামলা-মামলা দিয়ে কোনঠাসা করে রেখেছে। আমাদের দলীয় কার্যালয় দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। অফিসে প্রবেশ করতে পারি না। প্রশাসন সীলগালা করে রেখেছে। আমরা যদি কোথাও কোন বৈঠক করি সরকার উৎখাত ও নাশকতার মামালা দিয়ে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ঢাকাপ্রকাশ এর সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের রাজনীতি: ঠাকুরগাঁও - ১
নির্বাচন সামনে রেখে সাজানো হয়েছে নতুন কমিটি
তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এর পর ২০১৪ সালে আমরা কেউ ভোট দিতে পারেনি। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরী ভাবে সরকার খর্ব করেছে। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছে না কেউ। এর পরে ২০১৮ সালে আরো ভয়াবহ ভোট ডাকাতি। যেটা দিনের ভোট রাতেই হয়ে গেল।
জোরপূর্বক ভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। জামায়াতে ইসলামের পক্ষে থেকে সরকারের কাছে আবেদন অবিলম্বে দেশের মানুষের সুখ-শান্তির জন্য দ্রব্যমুল্যর বাজার নিয়ন্ত্রন করুন। বিরোধীদলের উপর যে জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও হামলা করছেন তা বন্ধ করুন।
জামায়াতের এই নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলাম একটি প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন। আমরা এ দেশের তৃতীয়বৃহত্ত শক্তি মনে করি। আমাদের উপর যে জুলুম- নির্যাতন চলছে, আমরা মনে করি একটি আদর্শবাদী দলকে এভাবে জুলুম-নির্যাতন করে কখনো স্তব্ধ করে রাখা যাবে না। আমরা তৃণমূল পর্যায়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত আগের চেয়ে কয়েক গুন শক্তিশালী হয়েছি। যখনেই ডাক পড়বে তখনেই কর্মীরা মনোবল শক্ত করে মাঠে নেমে পড়বে।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের রাজনীতি: ঠাকুরগাঁও-২
'বিএনপি আগের চেয়ে এখন অনেক শক্তিশালী'
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জামায়াতে ইসলাম নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। সরকার দেশের শীর্ষ আলেমদের বিনা অপরাধে জেলখানায় রেখেছে। আলেমরা জেলাখানায় ধুকেধুকে জীবন-যাপন করছে। কয়েকদিন আগে আমাদের আমীরে জামায়াতকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামালা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় তাহলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম অংশগ্রহণ করবে। ঠাকুরগাঁও তিন আসনেই ইতোমধ্যে প্রার্থী বাছাই করেছি এবং ঘোষণা করেছি। নির্বাচনকে সামনে রেখে উপজেলা, ইউনিয়ন ওয়ার্ড ও ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত আমরা কমিটি গঠণ করেছি।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা ব্যপক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তিনটি আসনেই প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে যার প্রমাণ হলো আমি নিজেই ২০১৪ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম।
জনগনের ব্যপক সাড়া পেয়েছি এবং সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলাম। পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে উপজেলার দায়িত্ব পালন করেছি। এই জন্য মানুষের মাঝে আমাদের আগ্রহ বেশি। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে যদি আমরা মাঠে নামি কেউ ঠেকাতে পারবে না।
অন্যদিকে, ঠাকুরগাঁও জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক বেলাল উদ্দীন প্রধান বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় তাহলে জেলার তিনটি আসনেই চমক দেখাবে জামায়াত। জেলার প্রত্যেকটি ইউনিট আমাদের শক্তিশালী। সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের দল পুরো প্রস্তুত থাকবে। কোন কোন্দল নেই আমাদের মাঝে। নেতা-কর্মীরা নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের রাজনীতি: ঠাকুরগাঁও-৩
দলীয় কার্যালয়ে তালা, নেই সন্ধ্যা বাতি দেওয়ার কেউ
অপদিকে, জেলা জামায়াতে ইসলামীর কার্যনির্বাহী সদস্য মাওলানা ফজলে রাব্বী বলেছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের উপর সরকার অনেক জুলুম নির্যাতন করেছে। বিনা অপরাধে আমাদের নেতাদের জেলে আটকে রেখেছে। দ্রব্যমুল্যর উর্দ্ধগতিতে জনগন নাভিঃশ্বাস। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে সরকার।
জামায়াতে ইসলামের পক্ষে থেকে সরকারের কাছে আবেদন অবিলম্বে দেশের মানুষের সুখ-শান্তির জন্য দ্রব্যমুল্যর বাজার নিয়ন্ত্রন করুন। বিরোধীদলের উপর যে জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও হামলা দিচ্ছেন তা বন্ধ করুন। জামায়াতের প্রতিটি ইউনিট অত্যন্ত সুসংগঠিত। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জামায়াত বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
জামায়াতে ইসলামের তৃণমূলের রাজনীতি নিয়ে সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি সঙ্গে কথা হলে তিনারা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী কৌশল অবলম্বন ও তৎপরতা চালাচ্ছে জামায়াত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির পুরোনো অধিকাংশ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
এরপর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে নেতারা। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে এরই মধ্যে জামায়াত দেশের যেসব এলাকায় তাদের সাংগঠনিক অবস্থান মজবুত এবং অতীতে নির্বাচন করেছে, সেসব এলাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত ও ঘোষণা করেছে এসব প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে নানাভাবে নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রচার চালাচ্ছেন।
আর পেশাজীবী সংগঠনের নেতা বলছেন, তৃণমূলের রাজনীতিতে জুলুম-নির্যাতন ও হামলা-মামলার মধ্যেও জামায়াত অনেকটা শক্তিশালী হয়েছে। তাদের কার্যক্রম এখন চোখে পড়ছে। ঠাকুরগাঁও পৌর-শহরের সরকার পাড়াস্থ নিজস্ব দলীয় কার্যালয়টি প্রায় একযুক ধরে তালাবন্ধ রয়েছে। এক ভূতুরের ঘর হিসেবে ঝাঁর-জঙ্গল অবস্থায় পড়ে আছে। তবে জামায়াতে ইসলামী সব থেকে ভালো অবস্থায় আছে। প্রকাশ্যে তারা নীরব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘর গোছানোর কাজ তারা করছে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে।
তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন তারাও গ্রেপ্তার আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এতো কিছুর পরও জামায়াত আছে, থাকবে। তাদের হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না।
এএজেড