মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাঘা ইউনুস পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার ৫১ বছর পাড় হলেও ফুলবাড়ী থানা স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনকারি দ্বিতীয় ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম ইউনুস আলী বাঘা ইউনুসের নাম মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত তালিকায় উঠেনি। বাঘা ইউনুসের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার সীমান্তঘেষা কুরুষাফেরুষা গ্রামে।
বাঘা ইউনুসের পরিবার ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শক্তিশালী নেতা মরহুম বাঘা ইউনুস পাকহানা বাহিনীর হাত থেকে দেশ রক্ষার জন্য ব্যাপক ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে বাঘা ইউনুস আলী ছিলেন সক্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে সেই সময় নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।
৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পর তার নের্তৃত্বে চাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রাম জোড়দার হয়ে উঠে ফুলবাড়ী অঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন তিনি এবং তাকে সেই সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। সংগ্রাম পরিসদের মাধ্যমে চালু করেন বেসামরিক প্রশাসন।
প্রশাসন স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা,মুক্তিডোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন,ছাত্র-যুবকদের বাঁচাই করে তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ কাজে সহযোগীতা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ সাম ফুলবাড়ী অঞ্চলকে হানাদার মুক্ত রাখতে জন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন বাঘা ইউনুস আলী।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ স্বীকৃতি রাখায় ২০০৪ সালে প্রাক্তন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। অন্য দিকে অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম বীর প্রতীক বদরুজ্জামান মিয়া সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গ্রন্থ,তাজুল মোহাম্মদ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের খোঁজে কুড়িগ্রাম গ্রন্থের তার অবদানের স্বীকৃতি তুলে ধরা হয়।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতি পট পরিবর্তনের পর তাকে রাজনৈতিক ভাবে তাকে জেলে যেতে হয়। সেই সময় তিনি পারিবারিক ভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে ৩৩ বছর আগে তার মৃত্যুর পর স্ত্রীসহ সন্তানরা চরম বিপাকে পড়েন। মহান স্বাধীনতার সময় লড়াই সংগ্রাম করে তিনি মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তিযুদ্ধে নের্তৃত্ব দেওয়ায় নানান স্বীকৃতিসহ সুনাম অর্জন করলেও পাননি রাষ্ট্রীয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
সেই সাথে স্বাধীনতার ৫১ বছরে এ উপজেলার অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পেলেও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাঘা ইউনুসের ভাগ্যে ৫১ বছরও জোটেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। ফলে বাঘা ইউনুসের পরিবার ও তার হাতে তৈরী অনেক মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় অনেকেই চরম ক্ষোভ জানিয়েছেন। সেই সাথে বাঘা ইউনুসের নাম দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জোড় দাবী জানিয়েছেন তার সহযোদ্ধাসহ পরিবার।
মরহুম বাঘা ইউনুসের সহধর্মিণী তহরিনা ইউনুস (৮০) জানান, আমার স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ রক্ষার জন্য সংসারসহ পরিবারকের সময় না দিয়ে বঙ্গবুন্ধর ডাকে সারা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন আমার বাড়ীতে মেজর নয়াজেশ ও দেলোয়ার হোসেন আসছিলেন। সেই সময় আমি নিজের হাতে রান্না-বান্না করে তাদেরকে খাওয়াইতাম।
পরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ক্যাম্পে যেত। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছরও রাষ্ট্রীয় ভাবে আমার স্বামীর নাম মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত তালিকায় ওঠেনি। তিনি বেঁচে থাকাকালীন তার নাম দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার চড়ান্ত তালিকায় অন্তভুক্তির জন্য সরকারের কাছে দাবী জানিয়েছেন। ছেলে জগলুল হায়দার ও জিয়াউল হায়দার জানান, তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠকের রাষ্ট্রীয় সম্মানের স্বীকৃতির জন্য ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করি। সেই সাথে ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাচাইয়ের তার নামটি 'ক' শ্রেণীতে তালিকা ভুক্ত হন।
সাক্ষাৎকার হলেও আজ পর্যন্ত অজানা কারণে মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত তালিকায় আমার বাবা মরহুম বাঘা ইউনুস আলীর নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই সরকারের কাছে বিশেষ আকুল আবেদন আমার বাবা মরহুম বাঘা ইউনুস আলীর নামটি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার চড়ান্ত তালিকায় অন্তভুক্তির জন্য জোড় দাবী জানাচ্ছি।
শুধু আমার বাঘা ইউনুস আলী নন তৎকালীন সময়ে সরকারী চাকুরিজীবী মরহুম সিরাজুল হক আনছারী ও থানা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্যসহ কয়েকজন অবহেলিত ক শ্রেনীর তালিকায় নাম উঠলেও স্বাধীনতার ৫১ বছরও চুড়ান্ত তালিকায় নাম অন্তভুক্ত হতে পারেনি।
বাঘা ইউনুস আলীর প্রতিবেশি বীরমুক্তিযোদ্ধা রস্তম আলী ও শাহজাহান জানান, ১৯৭১ সালে বীর প্রতীক বদরুজ্জামান সাহেব ও মরহুম বাঘা ইউনিুস আলীর নের্তৃত্বে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছি। আমরাসহ অনেকেই তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি। অথচ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বাঘা ইউনুস আলী সাবেহ স্বাধীনতার ৫১ বছরও মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত তালিকায় অন্তভুক্ত হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।
আমরা আমাদের প্রিয় নেতা মরহুম বাঘা ইউনুস আলীকে এই বিজয় মাসেই দ্রুত মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত চালিকায় অন্তভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনায়সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোড় দাবী জানাচ্ছি। বীরমুক্তিযোদ্ধা আমির আলী মিয়া জানান, তার নের্তৃত্বে তৎকালীন সময়ে আমি সংগ্রাম পরিষদের দপ্তর সম্পাদক থাকা কালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহন করেছি।
মুক্তিযোদ্ধের সময় তার যে অবদান সেটা কোন দিনও ভোলার মত নয়। অথচ স্বাধীনতার ৫১ বছরও তিনি মুক্তিযুদ্ধোর তালিকায় অন্তভুক্ত হতে পারেনি। এটা দুঃখজনক বিষয়। এটা আমরা মেনে নিতে পারছিনা। তাই সরকারের কাছে জোড় দাবী জানাচ্ছি আমার সহযোদ্ধা বাঘা ইউনুসকে চুড়ান্ত তালিকায় নামটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো:হাছেন আলী, মরহুম বাঘা ইউনুস আলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য বাঘা ইউনুস আলীর কৃতিত্ব, অবদান বিশদভাবে স্মৃতিচারণ করে জানান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হওয়ার পরও তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত না হওয়ায় আমরা নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন বাসী গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তিনি মরহুম বাঘা ইউনুস আলীর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন। ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জানান, মরহুম বাঘা ইউনুস আলী মুক্তিযোদ্ধার চুড়ান্ত তালিকায় আবেদন থাকলে আমরা তার ফাইলপত্রটি দেখে উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এএজেড