উত্তরাঞ্চলে বেড়েছে শীতজনিত রোগী, ডিসেম্বরে বাড়বে শৈত্যপ্রবাহ
এখনো কয়েক দিন বাকি পৌষ মাস পড়তে। এরই মধ্যে রংপুর বিভাগে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা নেমেছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শীতের শুরুতেই নাকাল হয়ে পড়েছেন শিশু ও বয়স্ক মানুষ। শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারদের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
এদিকে চলতি মাসেই রংপুর বিভাগে দুটি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেইসঙ্গে তাপমাত্রা আরও কমবে বলেও জানানো হয়েছে।
রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৬ ডিসেম্বর একদিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৯২ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করার খবর পাওয়া গেছে। গত এক সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তিন হাজারের বেশি শিশু। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় ২৭১ জন। যাদের সবার বয়স ১ মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে শিশু রোগীদের।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মোছা. শিখিলী খাতুন বলেন, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসে প্রতিদিন কম বেশি ৫০-৬০ শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে।
নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আসা এই নারী জানান, তার নাতির কয়েক দিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে বলেছেন।
বিভাগের রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট জেলার হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে। সামনে শীত বেশি পড়লে রোগীর চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন অভিজ্ঞ মহল।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেছেন, দিনাজপুর সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন শতাধিক শিশুকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ জন। শীতজনিত রোগের কারণে ১ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী বেশির ভাগ শিশুই এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়ারিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
দিনাজপুর অরবিন্দ শিশু হাসপাতাল, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগে তিন শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
পঞ্চগড়ে গেল কয়েকদিন ধরে ১১ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠা-নামা করছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিন ও রাতে তাপমাত্রা দুই রকম থাকায় এই জেলায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ।
নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৫৩ শিশু ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় একই বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে দুইজন করে শিশু। আবার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়।
কুড়িগ্রামে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে বেড়েছে রোগীর চাপ। হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৩৮ ও শিশু ওয়ার্ডে ৪৮ শয্যার বিপরীতে ৯০টি শিশু ভর্তি রয়েছে।
কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের রহিম বলেন, গত ৪-৫ দিন ধরে আমার ১১ মাসের শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে আছি। এখানে একটি বেডে দুজন করে শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
রংপুরের শিশু বিষেষজ্ঞ ডা. নুরুনন্নবী বলছেন, উত্তরাঞ্চল শীতপ্রবণ হওয়ায় এই সময়ে শীতজনিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। মৌসুমি আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে শিশু ও বয়স্কদের উপর। সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। আর শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। রোগ প্রতিরোধে শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি গরম কাপড় ও উষ্ণতার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
রংপুর মেডিকেলের হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরিফুল হাসান বলেছেন, শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, জ্বর ও শীতজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
ভারতের হিমালয়ের কাছাকাছি রংপুর বিভাগ হওয়ায় এখানে শীত তীব্র হয়। তেঁতুলিয়া জেলার আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ বলেন, জেলায় তাপমাত্রা কমছে। মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রেকর্ড করা হয় ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল ৯টায় রেকর্ড করা হয়। গত সোমবার রেকর্ড হয়েছিল ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা কমবে এবং বাড়বে শৈত্যপ্রবাহ। এখন তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৪ ডিগ্রিতে সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। ডিসেম্বর মাসে দুটি শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে।
এসএন