৭ বছর ধরে অচল রমেকের কোবাল্ট মেশিন
রংপুর মেডিকেলের হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার কোবাল্ট ৬৬ যন্ত্র ৭ বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। রংপুর মেডিকেল হাসপাতাল সুত্রে জানা যায়, রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু হয় ২০০১ সালের দিকে। ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ কোবাল্ট ৬০ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে কয়েকবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও সেটা চালু করা আজও সম্ভব হয়নি। বর্তমানে হাসপাতালের আউট ডোরে ৪টি বেড ও ভর্তি রোগীর ১০টি বেডে ক্যামোথ্যারাপি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক।
রংপুর মেডিকেল হাসপাতালের সুত্রে জানায়, ১৯৯৭ সালে প্রায় ৩৪ বছর আগে উত্তর অঞ্চলের ১৬ জেলার মানুষদের চিকিৎসার জন্য জেলা পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি কোবাল্ট ৬৬ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের প্রবেশ মুখে রেডিওথেরাপি বিভাগ। ভবনের একটি কক্ষে কোবাল্ট ৬৬ যন্ত্রটি অযত্নে পড়ে আছে। পাশের কক্ষে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কয়েকটি মনিটর। কাপড়ের ওপর ধুলোর আস্তর জমে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের থেরাপি দেওয়ার একমাত্র মেশিন হচ্ছে কোবাল্ট-৬৬ (টেলি থেরাপি)। যন্ত্রটি ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। হাসপাতালে নতুন টেলি থেরাপি মেশিন স্থাপনের কথা থাকলেও কবে নাগাদ তা স্থাপন করা হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মাত্র দুজন চিকিৎসক নির্ভর ১৪ শয্যাবিশিষ্ট ক্যামোথ্যারাপি বিভাগ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।
রংপুরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঁচটি কোবাল্ট-৬৬ মেশিন স্থাপন করা হয়। তিন বছর পর আনবিক কমিশন কর্তৃপক্ষ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের থেরাপি মেশিনটি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য অনুমতি দেয়। বিদেশি সাহায্য সংস্থার ১৪ কোটি টাকার অনুদানে এই পাঁচটি কোবাল্ট-৬৬ মেশিন ওই সময় পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন ও চালু করা হয়।
চীনের তৈরি এই মেশিনগুলো সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঢাকার মার্ডেল এজেন্সি (গুলশান ২, হাউস-২৩, রোড-৬৮/এ) সরকারের কাছে অনুমতি পায়। এই কোবাল্ট মেশিন চীন থেকে আনা হলেও ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যে সোর্স (যা উৎস থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মির বিকিরণ ঘটে) তা আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই সোর্স পরিবর্তন করতে হয়। কারণ এর কার্যকারিতা পাঁচ বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এরপর তা নিষস্ক্রিয় হয়ে যায়।
কোবাল্ট মেশিনটিতে সর্বশেষ সোর্স স্থাপন করা হয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পাঁচ বছর পর ২০০৯ সালে নতুন করে সোর্স স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি। ক্যান্সার রোগীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রটি দিয়ে গত বছর ১৫ মার্চ পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। কার্যাদেশে চারটি মেশিনের আনুষঙ্গিকসহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ ১১ হাজার ২৩২ মার্কিন ডলার। পাঁচ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবাসহ বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৭৬ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি মেশিনের মূল্য পড়ছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ক্যান্সার রোগীদের দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষা। অনেকেই ক্যান্সার কেমোথেরাপি নিচ্ছে। তাদের একজন রেজাউল ইসলাম (৬৯) গাইবান্ধার সুন্দরগজ্ঞ উপজেলাথেকে রংপুর মেডিকেলে রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য এসেছেন। তিনি প্রায় দেড় মাস সেখানে হোটেলে থেকে ৩০ সাইকেল থেরাপি নিয়েছেন। এতে করে তাঁর চিকিৎসার খরচ বেড়ে গেছে। একই জেলার ভোলাশেখ (৪২) সাদুল্যাপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসারা জানান, তিনি দুই জনেরই গলায় ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। অস্ত্রোপচারের পর ছয় সাইকেল কেমোথেরাপি নিয়েছেন। কিন্তু টাকার অভাবে রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন না।
ডাঃ জাহান আফরোজ খানম রেডিও থেরাপি বিভাগের চিকিৎসক জানান, সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর রেডিও থেরাপি বাবদ প্রতি ধাপে খরচ হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। সেখানে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ হয় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে রোগের ধরন অনুযায়ী ২৫ থেকে ৩০ দিন রেডিও থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হয় বলেও জানান তিনি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহান আফরোজ লাকি বলেন, বলেন, ক্যান্সারের রোগীর যে কষ্ট, যে ধরনের চিকিৎসা, ফলোআপ- সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপি নেওয়ার জন্য খুব সুন্দর একটা পরিবেশ হবে। সেই স্বপ্ন থেকে কেমোথেরাপি ইউনিট চালু করেছি। আশা করছি রোগীরা এখানে সুন্দর পরিবেশে কেমোথেরাপি নিতে পারবেন।
আপাতত শুধু কেমোথেরাপির সুযোগ থাকলেও ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে পুরুষদের ফুসফুস ও নারীদের স্থন, জরায়ু, নাক, কান, গলায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ শরিফুল হাসান-বলেন, কোবাল্ট যন্ত্রটি চালু করার জন্য আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগের পরিচালকরাও একাধিকবার চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
এএজেড