বাম্পার ফলনের পরও খরচ উঠবে না কৃষকদের!
দেশের শস্য ভান্ডার বলে পরিচিত রংপুরে চলতি মৌসুমে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে এবার জেলার মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত প্রায় তিন লাখ টনেরও বেশি আমন ধানের চাল দেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রংপুরের কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে কৃষকরা বলছেন, একদিকে চড়া সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ, সার ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি জমিতে সেচ দেওয়াসহ বিভিন্ন ভাবে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত অনেক টাকা খরচ হয়েছে। বাজারে যে দামে ধান, চাল বিক্রি হচ্ছে তাতে করে তাদের উৎপাদন খরচও উঠবে না। এমনকি সরকার যে ধান, চাল কেনার নতুন দাম নির্ধারণ করেছেন এই দর তাদের পোষাবে না।
অন্যদিকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় না করে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে চাল কেনার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য এবারও পাবে না। অথচ কম মূল্যে ধান কিনে ব্যবসায়ীরা চাল বানিয়ে সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল। সাধারণ কৃষকরা ধান বিক্রি করতে গেলে খাদ্য কর্মকর্তারা নানান অজুহাত দেখিয়ে ধান ক্রয় করতে অনীহা প্রকাশ আসলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ কৃষকদের।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শস্য ভান্ডার বলে খ্যাত রংপুরে চলতি আমন মৌসুমে আমন ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমি। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে ধান চাষ হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি। ইতিমধ্যে ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলার ৮ উপজেলায় শতকরা ২৬ ভাগ ধান কাটা মাড়াই শেষ হয়েছে। এতে করে প্রতি হেক্টরে সাড়ে ৫ মেট্রিক টন করে ধান এবং চাল সাড়ে ৩ টনেরও বেশি উৎপাদিত হয়েছে। সেই হিসেবে এবার চাল উৎপাদন হবার সম্ভাবনা রয়েছে ৪ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি। বিশেষ করে এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় কৃষকরা সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে জমি তৈরি করে চারা রোপন এবং বেশি দামে সার কিনে জমিতে প্রয়োগ করায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, রংপুর জেলার মানুষের চালের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন। সেখানে চাল উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। এর ফলে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যান্য জেলার প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে জানান কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
রংপুরের পীরগজ্ঞ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি, চতরা, সদরসহ কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, কর্শা, টেপামধুপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠ সোনালী ধানে ভরপুর হয়ে গেছে। প্রতিটি ধান গাছের থোকায় থোকায় ধান ধরেছে।
পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ি গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক আমজাদ, মোয়াজ্জেম হোসেন, সালামসহ অনেকেই জানান, সারের দাম বেড়েছে সেইসঙ্গে জমিতে সেচ দেবার জন্য ডিজেলসহ অন্যান্য সকল সামগ্রীর দাম বেড়েছে। এমনকি ধান রোপন করা থেকে কাটা পর্যন্ত কৃষান মজুরদের মজুরি বেড়েছে অনেক। ধান কাটতে একজন মজুর কমপক্ষে ৫০০ টাকা মজুরি নেয়। ধান চাষ করে যে টাকা খরচ হয়েছে সেটাই উঠছে না। অপরদিকে দাদন ব্যবসায়ী এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে ধান চাষ করে এখন বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে। এক মন ধান কমপক্ষে ১৫০০ থেকে থেকে ১৮০০ টাকা হলে তারা পোষাতে পারে। রংপুরের বিভিন্ন হাট বাজারে প্রতি মন ধান ১২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাউনিয়ার কৃষক গোলাম আজম, মানিক মিয়াসহ অনেকে বলেন, খাদ্য বিভাগ চাল কেনার দাম নির্ধারণ করেছে ৪২ টাকা মন হিসেবে আর ধান কিনবে ২৯ টাকা কেজি দরে । কিন্তু তারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান না কিনে মিল ও চাতালসহ বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল কেনেন। ফলে ওই সব ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে ধান কেনে নামমাত্র মূল্যে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ফলে ধান ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রংপুরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, খাদ্য বিভাগ ধান কাটা মাড়াইয়ের পরপরই যদি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করত তা হলে কৃষকরা একটু হলেও লাভবান হতো। তারা ধান কেনার কথা ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত সরাসরি ধান কিনছে না। ফলে যারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি তারা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে ধান কাটার পরেই কম দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে এ সময় বড় বড় ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কেনার আশায় ধান কেনা থেকে বিরত থাকে। ফলে তারা উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেছেন, অন্যান্য জেলার চাইতে রংপুরে আমন ধানের ফলন বাম্পার হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল অন্যান্য জেলার চাহিদা মেটাবে। বিশ্বে বৈশ্বিক মহামারীর আশঙ্কা করে খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় ঘি ঢেলে আমন ধান দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে অনেকটাই সক্ষম হবে। ধান কাটার পর ইরি-বোরো ধান রোপন করবে কৃষকরা। ফলে খাদ্য সংকট রংপুর অঞ্চলে হবার সম্ভাবনা নেই।
এসআইএইচ