রংপুর চিনিকল চালুর অপেক্ষায় চাষী-শ্রমিক-কর্মচারীরা
গাইবান্ধার একমাত্র কৃষিভিত্তিক শিল্প গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল। লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টির মধ্যে যে ৬টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়াত্ব এই চিনিকলটি ছিল।
বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াই ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দন্ডায়মান আখ রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন বিক্ষুব্ধ আখচাষী ও শ্রমিক-কর্মচারী। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন বা চাষীদের আকুতিকে বৃদ্ধাদ্ধুলী দেখিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ করেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষীরা।
তারা বলেন, তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষীদের উদ্দেশে দেশের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল যে আধুনিকায়ণের মাধ্যমে খুব দ্রুতই আবার চালু করা হবে এই চিনিকলসহ সকল চিনিকল। কিন্তু প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষী ছাড়াও বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের এই মাধ্যম রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি দুই বছরেও। বরং এই চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তারা আরও বলেন, কাজ হারানো চুক্তিভিত্তিক অর্ধসহ শতাধিক শ্রমিকরা এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিকশা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যদিকে চালু রাখা পাশ্ববর্তী চিনিকলের চাইতে অধিক মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন ও অধিক পরিমাণ আখ উৎপাদিত হলেও রহস্যজনক কারণে এই চিনিকলটি বন্ধ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকার হাজার হাজার আখচাষীসহ সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, গত দুই বছর চিনিকলটি বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এই দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যাবে খুব সহজেই। খোলা আকাশের নিচে অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলো ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে পড়েছে মরিচা। ফলে থমকে আছে আখচাষী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবিকার চাকাগুলো।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণ কাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলটির নির্মাণ কাজ তিন বছর পরে শেষ হলে ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আঁখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে মিলটিতে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। পশ্চিম জার্মানির বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠে এ চিনিকলের কারখানা ও কার্যালয়। এরপর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রংপুর চিনিকলসহ সকল চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন। সেইসঙ্গে চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য ৩৫ একর জমিতে আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়াও ৮ একর জায়গায় পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিং ও সাড়ে ১৪ একর জায়গায় ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং ৮টি সাবজোন গড়ে তোলা হয়। তা ছাড়াও মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৮৩২ একর।
এরপর ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে মিলের চাকা ঘোরে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন। এ সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
তারা আরও জানান, রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউজে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য। এজন্য রংপুর চিনিকলকে ঘিরে জাঁকজমক ছিল মহিমাগঞ্জ রেল স্টেশন। বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। এর পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়।
সব কিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল।
চিনিকল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার আওতাধীন চিনিকলগুলোকে। এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জিভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্ব ব্যাংকের এই ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল কবির জানান, চালু অবস্থায় এই চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতন ভাতা বাবদ মাসে প্রায় এক কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়া এই চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ২৬ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৬২ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ভাতা ২০ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ফারুক হোসেন ফটু জানান, দেশের কৃষক-শ্রমিক স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রায়াত্ব চিনি শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে। চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় অর্থনৈতিকসহ এই জনপদের সকল স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। বর্তমানের কৃষক ও শ্রমিক বান্ধব এই সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের এই জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
এদিকে মিলস গেট সাবজোনের আখ চাষী ফেরদৌস আলম অভিযোগ করে বলেন, রংপুর চিনিকলের চাইতে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখ জোন এলাকায় কয়েক গুণ কম উৎপাদন হয়। তারপরও ওই মিলটি চালু রেখে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহন করতে অতিরিক্ত ব্যায় হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। জয়পুরহাট ও শ্যামপুরের মধ্যবর্তী স্থানের রংপুর চিনিকলটি চালু রাখলে সরকারকে এই অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হতো না। মাথা ভারি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য প্রতি মৌসুমে লোকসান শিল্পটির কাঁধে আরও লোকসানের বোঝা চাপানো হচ্ছে।
এ কারণে চিনি শিল্প রক্ষার পাশাপাশি বন্যা-ভাঙ্গনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত গাইবান্ধার মানুষকে বাঁচাতে দ্রুত এই চিনিকলসহ বন্ধ সকল চিনিকল চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এই এলাকার কৃষক ও শ্রমিক-কর্মচারীসহ সকল স্তরের মানুষ।
এসআইএইচ