সন্তান লাভের আশায় মন্দিরে আঁচল পেতে ভিক্ষা
বিয়ে হয়েছে ৪ বছর আগে। কোন সন্তান হয় নাই এখনও। সদ্য স্নান শেষে ভেজা কাপড়ে মন্দিরের সামনে বসে আঁচল পেতে সন্তান লাভের জন্য ভিক্ষা চাইছেন। তাও যদি ঠাকুর মনের আশা পূরণ করে। এমনই বিশ্বাস নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসেছেন চম্পা রাণী নওগাঁর মান্দা উপজেলার রঘুনাথ জিউ মন্দিরে। শুধু চম্পা রানী নয় গোলাপি, বৃষ্টিসহ প্রায় ২০-২৫ জন নিঃসন্তান-বন্ধ্যা নারী সন্তানের আসায় শাড়ির আঁচল পেতে রঘুনাথ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে মন্দিরটি। রাম নবমী উপলক্ষে চৈত্র মাসে রামের জন্ম তৃতীয়া শুক্লা তিথিতে বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) ভোরে মন্দিরে ভগবান শ্রী রাম চন্দ্রের বিগ্রহে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুরু হয়। এরপর তীর্থ যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢল নামে হাজারো ভক্তের।
কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তদের পুজো অর্চনা, ভোগ নিবেদন ও মানত দেওয়ার মধ্য দিয়ে রামভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় মন্দির প্রাঙ্গণ। এছাড়াও রামনবমী উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুণ্যার্থীরা আসেন ঠাকুর দর্শন ও মানত করতে। আগত ভক্ত দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দিরের আশপাশের অন্তত এক কিলোমিটার এলাকা। এ উৎসবকে ঘিরে মন্দিরের পাশে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার।
নয় দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান চলবে আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। উৎসবের প্রথম দিনে নানা ধর্মের প্রায় হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে। প্রথম দিনেই ঠাকুর দর্শনে আসেন ভারতের সহকারী হাইকমিশনার মনোজ কুমার। জানা যায়, দপুন্ড্রদ জনপদের অন্যতম প্রাচীন জনপদ হিসেবে ঠাকুর মান্দার ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে। পাল আমলের বিভিন্ন নিদর্শন এই জনপদ থেকে আবিষ্কৃত হয়। জনপদটিতে রয়েছে হিন্দু তীর্থের প্রাচীন রঘুনাথ জিউ মন্দির। প্রতি বছর রাম নবমী পূজার দিনে জন্মান্ধ শিশুদের আনা হয় এখানে।
হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ নানান রোগের আক্রান্ত সন্তানদের নিয়ে আসেন এই মন্দিরে। ছোট্ট শিশু থেকে নানা বয়সের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও নানান রোগের আক্রান্তদের সারা দিন রেখে দেওয়া হয় মন্দির প্রাঙ্গণে একটি নির্ধারিত স্থানে।
পুণ্যার্থীরা একসময় মন্দিরের চারপাশের বিল ও শিব নদীতে গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে বিল থেকে পদ্মপাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শন করতে। ভক্তরা আজো সেই রীতি-নীতি মানতে চান। কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরণে নিবেদন করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি ভারত থেকেও আসেন হিন্দু পুণ্যার্থীরা।
অনেকে সপ্তাহব্যাপী মন্দিরের পাশে মাঠে তাবু গেড়েও অবস্থান করেন। ভক্তবৃন্দের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে রাতে পদাবলী কীর্তনেরও আসর বসানো হয়। মন্দিরটিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাম নবমীর উৎসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে। এ উপলক্ষ্যে মন্দিরটিকে ঘিরে জুড়ে বসেছে গ্রামীন মেলা।
ঢাকা থেকে এসেছেন সুকলা সরকার। তিনি বলেন, আমার ছেলে কথা বলতে ও হাঁটতে পারে না। শুনেছি এখানে এসে মনো বাসনা পূরণ করার জন্য মানত করলে ঠাকুর তা পূরণ করেন। এই জন্যই এখানে এসেছি।
বগুড়ার সান্তাহার থেকে এসেছেন পলাশ সরকার। তিনি বলেন, প্রতি বছর এই রাম নবমীতে ঠাকুরকে দর্শের জন্য এখানে আসি। পরিবারের সবাই যেন সুখে-শান্তিতে থাকে এই জন্য।
নওগাঁর পত্নীতলা থেকে এসেছেন শ্রী রবিদাস। তিনি বলেন, আমার ছেলের একটা মানত ছিলো। এবং পরবর্তীতে আমার ছেলে সুস্থ হয়ে গেছে। এই জন্য মানত পূরন করতে মূলত এখানে আসা।
মন্দির কমিটির সভাপতি চন্দন কুমার মৈত্র বলেন, রঘুনাথ জিউ মন্দির প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এই মন্দির শুধু বাংলাদেশে না বাংলাদেশের বাইরেও পরিচিতি আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্তদের আগমন ঘটে মন্দির চত্বরে।
তিনি বলেন, হাজারো ভক্ত মন্দিরে মানত করতে এসে উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করে। সেইভাবে থাকার কোন জায়গা নেই। ভক্তদের অনেক কষ্ট করতে হয়। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাবো এই মন্দিরের দিকে নজর দেওয়ার জন্য।
এএজেড