বিনাযুদ্ধে শত্রুমুক্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর
আজ ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তি বাহিনী জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে এবং উদ্ধ আকাশে ফায়ার করতে করতে তৎকালীন মহকুমা শহর নবাবগঞ্জে প্রবেশ করে। শত্রু পক্ষের কোন প্রকার বাধা ছাড়াই নবাবগঞ্জ শহর জয় করে মুক্তি বাহিনী। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় অবরুদ্ধ জনতা। এই দিন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই রাস্তায় বের হয়ে আসে, মেতে ওঠে বিজয় উল্লাসে।
মুক্তিকামী মানুষের চোখে-মুখে আনন্দ অশ্রু-হাসি, বিজয়ের উল্লাস আর কন্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি। মুক্তি বাহিনী ও অবমুক্ত হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ নবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে জড়ো হয়ে মুক্তির আনন্দ উল্লাসে, জয় বাংলা ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা সমগ্র নবাবগঞ্জ মহকুমাকে শত্রু মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই সেক্টরের বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী পর্যদুস্ত হয়ে পরাজিত হয়।
৬ ডিসেম্বর বিনোদপুর, ১১ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ, ভোলাহাট ও রহনপুর শত্রু মুক্ত করে মুক্তি বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর নবাবগঞ্জ শহর শত্রু মুক্ত করতে এডভান্স হয়। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী নবাবগঞ্জ শহরের তিন দিকে অবস্থান নিয়ে রাতভর ফায়ার চালিয়ে শত্রু পক্ষের অবস্থান, শক্তি ও সমর কৌশল বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু শত্রু পক্ষের পাল্টা কোন জবাব না পেয়ে, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর অপর পাড় বারঘরিয়া চামাগ্রাম এলাকা ৭ নম্বর সেক্টরের অন্যতম উপ প্রধান ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ওরফে রণাঙ্গনের টাইগার জাহাঙ্গীর ১৪ ডিসেম্বর ভোরের ঊষার আলোয় কয়েক জন সঙ্গী নিয়ে নৌকায় মহানন্দা নদী পার হয়ে রেহাইচর এলাকায় কয়েকটি বাঙ্কারে শত্রু পক্ষের খোঁজে গ্রেনেড চার্জ করে।
এ সময় লুকিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন রাজাকারের বুলেটের আঘাতে তিনি শহীদ হন। পূর্ব পরিকল্পনার ১৪ ডিসেম্বরের পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনীর রহনপুর থেকে এডভান্স হয়ে আসা স্কোয়াডন লিভার আব্দুস সামাদ ও তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা মো তুফান আলী ও সহযোদ্ধারা নয়াগোলা এলাকা দিয়ে, দিয়াড় থেকে এডভান্স হয়ে আসা মিরের চরে অবস্থান নেয়য়া মুক্তিযোদ্ধা একরামুল হক ফিটু ও সহযোদ্ধারা গজ- গজিয়ে পাড়া দিয়ে এবং সোনামসজিদ ও শিবগঞ্জ এলাকা থেকে এডভান্স হয়ে আসা বারঘরিয়া চামাগ্রাম এলাকায় অবস্থানকৃত মুক্তি বাহিনী একযোগে নবাবগঞ্জ মহকুমা শহরে জয় বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে এবং উদ্ধমুখী ফায়ার করতে করতে শহরে প্রবেশ করে।
পরে জানতে পারেন নবাবগঞ্জ শহর থেকে সর্বশেষ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যেই পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে তাদের এ দেশীয় দোসরদের ফেলে পালিয়ে যায়। রাজাকারা বিচ্ছিন্ন ভাবে আত্মগোপন করে। তারা স্থানীয় লোক হওয়ায় পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যায়। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, গোলাম নবী সাটুসহ নাম জানা না জানা শহীদদের মরণপণ যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই দিনেই দুর্দান্ত ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা শহীদ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের লাশ সহযোদ্ধারা বহন করে সোনামসজিদের সামনে সমাধিত করে। এক শত্রু মুক্ত বিজয়ের আনন্দ অন্যদিকে বিজয়ের ঊষা লগ্নে সহযোদ্ধা হারানোর বিষাদ।
মুক্তিযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নং সেক্টরের অধীনে। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান চৌধুরী। ৭নং সেক্টরের অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমায় ছিল দুটি সাব সেক্টর। একটি মোহদিপুর সাব সেক্টর অন্যটি দলদলী সাব সেক্টর। মোহদিপুর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এবং দলদলী সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট রফিক। এদিকে, দিবসটি উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বের করা হয় বর্ণাঢ্য র্যালি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালিটি বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও মুক্ত দিবস উপলক্ষে র্যালি বের করে।
এএজেড