কাগজ সংকট, হুমকির মুখে রাজশাহীর প্রকাশনা শিল্প
আগে থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত রাজশাহীর প্রকাশনা শিল্প। এর মধ্যে ‘মরার উপর খরার ঘা’ এর মতোই লাগামহীনভাবে বাড়ছে এই শিল্পের কাঁচামালের দাম। শুধুমাত্র মূল্যবৃদ্ধিই নয়, টাকার বিনিময়েও প্রয়োজনীয় কাগজ পাচ্ছেন না তারা। এতে হুমকির মুখে পড়েছ এই অঞ্চলের প্রকাশনা শিল্প।
প্রকাশক ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণ কাগজ ও কালির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বাড়তি দামেও প্রতিদিনের চাহিদা মাফিক কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি কাগজ মিলগুলো এখন বন্ধ। বসুন্ধরা গ্রুপের কাগজই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়াও ফ্রেশ কোম্পানিসহ দুটি কাগজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তেমন একটা কাগজ দিতে পারছে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জাতীয় বই মেলার পূর্বে ও বছরের শেষের এই সময়টা প্রকাশনা শিল্পের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভরা মৌসুমও বলা চলে। কিন্তু এই সময়ে কাগজের জন্য তারা কাজ করতে পারছেন না। অনেক প্রকাশক কাগজের বাড়তি দামের কারণে এখন বই প্রকাশ করা থেকেও বিরত থাকছেন। এছাড়া আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকাগুলোও অনেকে সার্কুলেশন কমিয়ে দিয়েছে। পত্রিকাগুলোও সংকটে ধুকছে। কেউ কেউ পত্রিকা ছাপা বন্ধও করে দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। অলস সময় পার করছে শ্রমিকরাও।
নগরীর প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত তিন-চার মাসের ব্যবধানে রাজশাহীর বাজারে কাগজের দাম কোনও কোনও ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ৫৫ গ্রাম কাগজ আগে ১ হাজার ২৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও সেই কাগজ এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। ৮০ গ্রাম কাগজের দাম ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। গ্লোসারি ১০০ গ্রাম কাগজ আগে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত। আগে সুইটিজ বোর্ড ২০ থেকে ২১ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৩ টাকায়। এ ছাড়াও ডিলার পর্যায়ে প্রত্যেক টন কাগজে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়তি। শুধু কাগজই নয়, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকল উপকরণের দামই বাড়তি। আগে ২ পাউন্ড কালি ৩৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৬০ টাকা। আগে ৫ লিটার কেরোসিনের দাম ৩২৯ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা। জেট অ্যামোইল আগে ৮৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। এ ছাড়াও এখন বইয়ের বাইন্ডিং খরচ আগে জ্যাকেট বাধাইয়ে ১৯ থেকে ২০ টাকা হলেও এখন তা নেওয়া হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা।
নগরীর নিউমার্কেট, ষষ্ঠিতলা, গোরহাঙ্গা ও আশেপাশের এলাকার প্রিন্টিং প্রেস কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখছেন কারখানা। যেসব প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রয়েছে সেখানেও শ্রমিকদের অলস সময় পার করতে দেখা যাচ্ছে।
নগরীর নিউ মার্কেট সুলতানাবাদ এলাকায় অবস্থিত রংধনু অফসেট প্রিন্টিং প্রেসের প্রোপ্রাইটর মো. তাজউল ইসলাম জানান, করোনাকালীন তিনি সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছেন। করোনার ক্ষত পুনর্গঠনের আগেই নতুন সংকটের মুখে পড়েছেন। এই শিল্পের উপকরণ একটি ব্লেড থেকে শুরু করে সকল কিছুর দাম বেড়েছে। এ কারণে নিয়মিত গ্রাহকরাও একান্ত জরুরি ছাড়া আসছেন না। আবার চাহিদা অনুযায়ী কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে অধিকাংশ সময়ই কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
রাজশাহীর পত্রিকাগুলোর দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরে দৈনিক সোনালি সংবাদের সম্পাদক লিয়াকত আলী জানান, পত্রিকা সাধারণত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞাপন পত্রিকার আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। কিন্তু করোনার মধ্যে বিজ্ঞাপন ছিল না বললেই চলে। কোনো মতে তারা প্রতিষ্ঠানকে চালিয়ে যাচ্ছেন। রঙিন থেকে সাদাকালো করে পত্রিকা ছাপাতে হয়েছে। করোনা পরবর্তীতে যখন তারা কিছুটা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন এর মধ্যে কাগজসহ অন্যান্য উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নতুন সংকট এসে পড়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে রাজশাহীর আঞ্চলিক প্রিন্ট পত্রিকাগুলো আর কতদিন টিকে থাকতে পারবে এটাই বড় প্রশ্ন তার কাছে।
এদিকে রাজশাহীতে এখনও প্রকাশনা ব্যবসা তেমন জমে উঠেনি। এখানে লেখকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বেশি বই ছাপান। এমন পরিস্থিতিতে তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আবার মফস্বল এলাকায় থেকে যারা রাজধানীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাচ্ছেন এমন উদীয়মান প্রতিষ্ঠানও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
নগরীর সিঅ্যান্ডবি এলাকায় অবস্থিত স্ব-চিত্র প্রকাশনীর কর্ণধার ফাহমিদুর রহমান জানান, মফস্বল এলাকায় অবস্থান করে সৃজনশীল প্রকাশনী নিয়ে কাজ করা দুরুহ বিষয়। তবে তিনি রাজশাহী থেকে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃজনশীল প্রকাশনী নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু করোনার পর আবারও নতুন সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। আসন্ন জাতীয় বই মেলাকে সামনে রেখে মোট ২৭টি বই প্রকাশের পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতির শিকার হয়ে ৮টির বেশি পারছেন না। এতে তিনি আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি লেখকদের আগ্রহ কমছে। বইয়ের বিক্রিও কমেছে। সৃজনশীল বিকাশের পথও রুদ্ধ হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বাগতম নস্কার জানান, মুদ্রণ শিল্প করোনার মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে পড়েছিল। অনেকে এই সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আর রাজশাহীর মতো জায়গায় ক্ষতির মুখেও তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনও রকমে টিকে আছেন। কিন্তু করোনা পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও নতুন সংকটের মুখে পড়েছেন। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা উর্ধ্বমুখি। আবার চাহিদা অনুযায়ী কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানাও অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছেন তারা।
তিনি আরও জানান, রাজশাহীতে আগে মাসে ১৩-১৪টি ট্রাকে করে বসুন্ধরার কাগজ আসত সেখানে এখন আসে ৩-৪ ট্রাক। অন্য কোম্পানিগুলোর কাগজ সরবরাহ নেই বললেই চলে। এখন বসুন্ধরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের কাগজ বিক্রির জন্য রাজশাহীতে চারজন ডিলার রয়েছেন। এরমধ্যে একজন কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রতি মাসেই কাগজের দাম কিছু না কিছু বেড়েছে এটা সত্য। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এমনটা হয়েছে। আর দাম বৃদ্ধির কারণে রাজশাহীতে চাহিদা কমেছে। তার নিজেরই একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে। আগে তার প্রতিষ্ঠানের জন্য যেখানে ১০ টন কাগজ লাগত। সেখানে তিনি ২ টনের কাজ করতে পারছেন।