প্লাস্টিকের দাপটে বাঁশের শিল্প বিলুপ্তির পথে
ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চালুনি, হাতপাখাসহ বাঁশের তৈরি নানা পণ্য বানিয়ে তা বিক্রি করেন জয়পুরহাটের আয়শা বেগম। সকালে এ জেলার সদর উপজেলার খঞ্জনপুর এলাকায় এমদাদুল হকের দোকানে বসে কাজ করেন। তার বিনিময়ে যা আয়-রোজগার করেন তা নিয়ে সন্তানসন্ততি নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তবে উদ্বিগ্নতার কথা হচ্ছে প্লাস্টিকের পণ্যের কদর বেড়ে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসছে বাঁশ দিয়ে তৈরি শিল্পসামগ্রী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক পণ্য যত সহজলভ্য হয়েছে, ততই বাঁশের তৈরি শিল্পের কদর কমেছে। বাঁশপণ্যের চলমান এ খরায় কারিগররাও রয়েছেন বিপাকে
বাঁশের তৈরি পণ্য আমাদের লোকজ শিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ বহু মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে এ শিল্পের সঙ্গে। কালের বিবর্তনে ও প্রযুক্তির বদৌলতে প্রাচীন এ শিল্পের ঐতিহ্য এখন ভাটার দিকে। বাঁশের তৈরি পণ্য দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করা যায় না, ফলে মেয়াদের প্রশ্নে মানুষের নজর কেড়েছে প্লাস্টিক। তা ছাড়া কম দামে প্লাস্টিকপণ্য কিনতে পারায় মানুষ দিনে দিনে বাঁশের তৈরি পণ্য ছেড়ে ঝুঁকছেন প্লাস্টিক দূষণের দিকে। সবখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্লাস্টিক আর চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন আমাদের বাঁশের শিল্পী ও কারিগররা।
সরেজমিন দেখা যায়, জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর এলাকার রাস্তার মোড়ে বাঁশ দিয়ে তৈরি শিল্পসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। বাঁশের তৈরি হরেকরকম পণ্যে সাজানো দোকান দেখে মনে হবে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। ক্রেতার সংখ্যা তেমন নেই বললেই চলে। দোকানে সাজানো আছে বাঁশ দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, খাঁচা, মাচা, খালই, মাছ ধরার বাইড়, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়া, মাছ ধরার চাঁই, ঠুয়া, টুকরি, খাদা, উড়ি, মাথাল, ঝাঁপ, ডালা, বেলকি, তালের পাখা, শীতলপাটি, খেজুর পাতার ঝাড়ু, নকশিপাটি, ফুলঝাড়ুসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী। ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির চরম দুর্দিন চলছে। এ দুর্দিন কাটিয়ে এ শিল্পের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ। স্থানীয়রা মনে করেন, শিল্পী ও কারিগরদের ব্যক্তিগত চেষ্টার পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা এই শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাঁশ, বেত দিয়ে তৈরি পণ্যসামগ্রীর দাম। চাটাই ১০০-১৫০ টাকা, কুলা ১০০-১৩০ টাকা, চালুন ৮০- ১৫০ টাকা, খাঁচা ১০০-৩০০ টাকা, মাচা ১৫০-৩০০ টাকা, মাছ ধরা বাইড় ১০০-৫০০ টাকা, মই ২০০-৫০০ টাকা, ঠুয়া ৫০-১০০ টাকা, টুকরি ৫০-৮০ টাকা, খাদা ১০০-২৫০ টাকা, উড়ি ৫০ টাকা, মাথাল ১০০-২০০ টাকা, ডালা ৬০-১০০ টাকা, তালের পাখা ৩০-৮০ টাকা, পাটি ৮০-১০০০ টাকা, খালই ৫০-১০০ টাকা, ঝাড়ু ৬০-১০০ টাকায় খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।
বাঁশপণ্যের ক্রেতা উজালা রানী বলেন, আমি কুলা কিনতে এসেছি। কারণ আমনধান ঘরে আসছে। ধান পরিষ্কার করাসহ বিভিন্ন কাজে কুলার প্রয়োজন হয়। ১০০ টাকা দিয়ে কুলা কিনলাম। তবে আরও কিছু জিনিস কিনব।
খঞ্জনপুরের বাঁশপণ্য বিক্রেতা এমদাদুল হক জানান, একসময় বাঁশের তৈরি পণ্যের অনেক চাহিদা ছিল। প্লাস্টিক এসে ব্যবসা নষ্ট করে দিয়েছে। আদি পেশা হিসেবে এখনো ধরে রেখেছি এ ব্যবসা। আগে নিজের তৈরি জিনিস বিক্রি করতাম। এখন আমাদের গ্রামে অনেকেই আছেন আর আগের মতো তৈরি করে না, তাই বাইরে থেকে কিনে বিক্রি করি। সব জিনিসের দাম বাড়লেও এটার দাম তুলনামূলক কম। প্লাস্টিকের পণ্যে বাজার ভরে গেছে। যেটুকু পণ্য বিক্রি হয় তা দিয়ে কোনোরকম চলে যাচ্ছি। এ ব্যবসার উপর আমার পুরো সংসার নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় সংসার চালানো দায় হয়েছে।
জয়পুরহাট বিসিক শিল্পনগরী উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ বলেন, এ জেলার পাঁচটি উপজেলায় বাঁশের তৈরি পণ্যের কারিগর ১ হাজার বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এই বাঁশ শিল্পে যারা কর্মরত আছেন তাদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং যাদের ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা দেওয়ার মত তাদের ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় আনা হয়।
এসএন