সিরাজগঞ্জের জুট কাপড়ের তৈরি কম্বলই গরিবের সম্বল
শীতকালে একটি গরম কাপড়ের অভাবে দুভোর্গ পোহাতে হয় ফুটপাট, বস্তি ও রেল স্টেশনের অসহায় শিশু-নারী- বয়োজ্যেষ্ঠদের। কারণ শীতের রাতের কুয়াশা ও ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসে কাপতে হয় তাদের। আর এ দুভোর্গ থেকে রেহাই পেতে গার্মেন্টসের ফেলে দেওয়া ঝুট কাপড়ের তৈরি কম্বলের উপর তাদের নির্ভর করতে হয়। সেই কম্বল তৈরি হচ্ছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে। কাজিপুরের শিমুলদাইড় বাজার, ছালাভরা, বরশীভাঙ্গা, সাতকয়া, কুনকুনিয়া, পাইকরতলী, গাড়াবেড়, মাইজবাড়ি, চালিতা ডাঙ্গা, মেঘাই, শ্যামপুর, নয়াপাড়া, গাঁন্ধাইলসহ প্রায় ৩০টি গ্রামে গার্মেন্টসের ঝুট দিয়ে নানা রং বে-রংয়ের বাহারি কম্বল তৈরি করছেন কারিগররা। তাদের তৈরি সেই কম্বল এখন জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে যমুনা নদীর ভাঙ্গা-গড়ার সংগ্রাম করতে করতে বসতভিটা ও ফসলি জমিসহ সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে পড়ে অনেকেই। তখন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার বড়শীভাঙ্গার সাইদুল হক নামের অর্ধশিক্ষিত এক ব্যক্তি বিকল্প উপার্জনের পথ খুঁজতে চলে যান ঢাকার মিরপুরে। সেখানেই পরিচয় হয় এক ঝুট কাপড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তার কথায় ঝুট কাপড় কিনে চলে আসেন বাড়িতে। সেই ঝুট কাপড় সেলাই করে তৈরি করেন কম্বল। এরপর তৈরি করা কম্বল সাইকেলের পেছনে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে বিক্রি শুরু করেন। কম্বল বিক্রির সেই টাকায় বদলাতে থাকে সাইদুলের জীবন। তার দেখায় একই গ্রামের চাঁন মিয়া, হাজী জিয়াউল হক, মনির হোসেনসহ প্রায় ৫ জন শুরু করেন কম্বল তৈরির ব্যবসা। সেই থেকেই কাজিপুর উপজেলায় শুরু হয় কম্বল তৈরির কাজ। তার পর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি এই অঞ্চলের মানুষের।
আরও জানা গেছে, একেকটি কম্বল তৈরিতে মজুরি বাবদ ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে পেয়ে থাকেন কারিগররা। আর ফ্লাডলক মেশিনে ৪ জন শ্রমিক প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ পিস কম্বল তৈরি করে থাকেন। মেয়েদের কম্বল তৈরিতে মজুরী কম হলেও গৃহস্থালীর কাজের ফাঁকে শীত মৌসুমে পরিবারের ছেলে-মেয়ে ও পুত্রবধূসহ সকলেই মিলে মিশে কম্বল সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে সহজেই শীত মৌসুমে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও সংসারের জন্য বাড়তি আয় করে থাকেন।
কাজিপুরের তৈরি কম্বল এখন কিনে নিয়ে যান নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, লালমনিরহাট, নীলফামারী, খুলনা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারী মহাজনরা।
বড়শীভাঙ্গা গ্রামের কম্বল তৈরির কারিগর খালেদা বেগম জানান, পরিবারের স্বামীসহ ৪ সদস্য। এক ছেলে এক মেয়ে। নদী ভাঙ্গন এলাকায় পরিবারের পুরুষদের হাতে তেমন কাজকর্ম থাকে না। এ কারণে বছরজুড়ে সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকে। শীত মৌসুম আসলে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি মায়ের সেলাইয়ের কাজে টুকরো কাপড় গুছিয়ে মাকে কম্বল তৈরিতে সহযোগিতা করে। কম্বল তৈরি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে অভাবকে আমরা দূর করতে সক্ষম হয়েছি।
খালেদার স্বামী ফ্লাডলক মেশিনের কারিগর মোতাহার হোসেন জানান, শিমুলদাইড় বাজারে কম্বল তৈরির কাজ করেন। তিনি প্রতিদিন প্রায় ৮/৯০০ টাকা আয় করেন। এতে তাদের সংসারের খরচ বাদে ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না।
শুধু মোতাহার হোসেনই নয় শীতের এই মৌসুমে কম্বল পল্লীর কয়েক শতাধিক পরিবার আয়ের মুখ দেখেছে। জানা গেছে, ওই এলাকায় ১৫ হাজার পা মেশীন ছাড়াও শিমুলদাইড় বাজারে রয়েছে প্রায় ৩০০ যন্ত্র চালিত ফ্লাডলক পাওয়ার মেশিন।
ফ্লাডলক পাওয়ার মেশিনের আরের কারিগর মজনু শেখ জানান, পাওয়ার মেশিনে প্রতিদিন চারজন কারিগর কাজ করে থাকেন। গড়ে চারজন কারিগর মিলে একটি পাওয়ার মেশিনের আওতায় ৮০০ থেকে ৯০০ পিচ কম্বল তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে কারিগররা একেক জন ৮/৯০০ টাকা আয় করে থাকেন।
শিমুলদাইড় বাজারের ঝুট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম জানান, ১৯৯৪ সাল থেকেই ঝুঁট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরি শুরু করে স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে কম্বলের পাশাপাশি ছোট ছেলে-মেয়েদের পোশাকসহ প্রায় ৫২টি পণ্য এই এলাকায় তৈরি হচ্ছে। শীতের এই মৌসুমে শিমুলদাইড় বাজার হতে ১৮ থেকে ২০ লাখ পিস কম্বল দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।
শিমুলদাইড় বাজার কমিটির সভাপতি মো. আবু তাহের জানান, এক সময় এই ব্যবসাটি স্থানীয় পর্যায়ে হলেও সময়ের ব্যবধানে এর পরিধি বেড়ে দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে স্থানীয় ব্যাপারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে নদী ভাঙন কবলিত মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক উন্নতি হবে।
চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মুকুল জানান, শীত মৌসুমে শিমুলদাইড় বাজারে শত কোটি টাকার ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। কিন্তু হাতের কাছে ব্যাংক ব্যবস্থা না থাকায় দুর-দুরান্ত থেকে মহাজনদের টাকা লেনদেন নিয়ে ঝাঁমেলা পোহাতে হয়। এ ছাড়াও এখানে রাস্তাগুলো খুবই খারাপ মানের হওয়ায় যাতায়াতে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী বলেন, কাজিপুরের কম্বল তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় অনেক বেকারত্ব দূর হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যর সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবসাটির প্রসার লাভে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি এমদাদুল হক এমদাদ বলেন, এই শিল্পকে কেন্দ্র করে কাজীপুরে গড়ে উঠেছে কম্বলের বাজার। দামে কম আর উন্নত মানের হওয়ায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আসছেন কম্বল কিনতে। সরকার ও দেশের বিত্তবানরা ত্রাণের জন্য দেশের বাইরে থেকে কম্বল আমদানি না করে এখান থেকে কিনলে আমাদের এই শিল্পটির আরো প্রসার হবে।
এ ব্যাপারে কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুখময় সরকার জানান, এই শিল্পের প্রসারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সেই সাথে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করব। আশা করি এক সময় এই শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
এসআইএইচ