রাজশাহী মেডিকেলে থমথমে অবস্থা, কাটেনি আতঙ্ক
বুধবার (১৯ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে হামলা-মামলা-ধর্মঘট-আন্দোলনে উত্তাল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে এখনও থমথমে, নিরবতা অবস্থা বিরাজ করছে। মধ্যরাতে জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেয়েছে সাধারণ রোগীরা। তবে আতঙ্ক কাটেনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) বিকালে হাসপাতালের পরিচালক ও মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এরপরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে চিকিৎসা কার্যক্রম। কাজে ফিরছে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এ ছাড়াও রামেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন মেডিকেলের পক্ষে রাজপড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে শিক্ষার্থীদের আসামি করে মামলা নথিভুক্ত করার আবেদনে ক্ষোভ ছড়িয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। অন্যদিকে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদ।
ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইমরান হোসেন জানান, শুক্রবার (২১ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত ধর্মঘট শিথিল করা হয়েছে। শুক্রবার যথারীতি অন্য সময়ের মতো ইন্টার্নরা চিকিৎসা সেবা দিবেন। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে মামলা করেছে সেখানে আসামিদের আগামী ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ শুক্রবারের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে। অন্যথায় শনিবার (২২ অক্টোবর) মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। সেখান থেকে বৃহত্তর কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
এদিকে ধর্মঘটের স্থগিতের ঘোষণার পর চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রামেক হাসাপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ৮ নম্বর ওয়ার্ডসহ পুরো ক্যাম্পাস থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সন্ধ্যায় সিনিয়র ডা. আয়েশা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন। তবে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। সেবা সংশ্লিষ্টদের চোখে-মুখে এখনও আতঙ্ক ফুটে উঠছে।
তবে রোগী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হামলার পরপর সাধারণ রোগীরা জিম্মি দশার মধ্যে ছিলেন। এক রকম আতঙ্ক বিরাজ করছিল। একদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অন্যদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আন্দোলন। ইন্টার্নরা ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার পর অনেকেই বিপাকে পড়েছিলেন। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সিনিয়র রোগীরা চিকিৎসা দিয়েছেন। এতে তেমন কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি।
এ ব্যাপারে নওগাঁর বাসিন্দা রাব্বি হোসেন নামের রোগীর এক স্বজন জানান, তিনি ১৫ দিন থেকে হাসপাতালে আছেন। এর মধ্যে সিনিয়র ডাক্তার দিনে একবারের বেশি দুই বার দেখা যায়নি। এমনও হয়েছে সিনিয়র ডা. আসেনই নি। তবে বৃহস্পতিবার কয়েক দফায় সিনিয়র ডাক্তার এসে রোগী দেখেছেন। রুমে সবসময় একজন করে থাকছেন। সুতরাং তেমন কোনো দুর্ভোগ এখন নেই।
অপরদিকে রামেক হাসপাতালের পক্ষে বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে রাজপাড়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র শাহরিয়ারের মৃতুকে কেন্দ্র করে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রের নেতৃত্বে ৩ শতাধিক ছাত্র হাসপাতালে তান্ডব চালিয়েছে। এসময় তারা চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মচারীদের গালিগালাজ, লাঞ্চিত ও মারধর করে সরকারি কাজে বাধাদান ও সম্পদ নষ্ট করে। এ বিষয়ে মামলা এজাহারভুক্ত করতে অনুরোধ জানানো হয়।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা সর্ম্পকে জানতে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে মৃত শিক্ষার্থীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিশ্ববিদ্যালয়েরর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পরিবারের কাছে শাহরিয়ারের লাশ হস্তান্তর করে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয়। সকাল ৯টায় জানাজা শেষে শাহরিয়ারের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়।
জানাজা শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, তারা এ ঘটনায় মর্মাহত। তাদের একজন সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী চলে গেলেন। গতকাল রাতে শাহরিয়ারের দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আলাদা তদন্ত কমিটি হবে।
উল্লেখ্য, গত বুধবার (১৯ অক্টোবর) দিবাগত রাতে আবাসিক হলের ছাদ থেকে পড়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন রাবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ার। চিকিৎসা দিতে বিলম্ব, ডাক্তারদের দুর্ব্যবহার ও শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
এরপর রাত ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে রামেকের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। পরে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়াও ঘটনার তদন্তে রামেকের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে চিকিৎসকদের দুইজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন এবং পুলিশ প্রশাসনের দুইজনকে সদস্য করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে ঘটনার অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এসআইএইচ