'ছিঁড়া জুতা সেলাই করলেও হয় না সংসার সেলাই'

বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খেটে-খাওয়া, নিম্ন, স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষ ভোর ৫ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ওএমএসের দোকানগুলোতে লম্বা লাইন ধরে ভিড় করতে দেখা যায়। কেউ চাল না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কপালে ভাজ দিয়ে হতাশা নিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফেরছেন। অনেকেই শুধু চাল ও আটা কিনতে পারলেও মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ সংসারের বাজার তালিকার অন্য সবকিছুই বাইরে থেকে বেশি দামে কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
সারাদেশের মতোই জয়পুরহাটে নিম্ন আয়ের মানুষের সংসার চালান যেন আইসিইউ রোগির মত অবস্থা তৈরী হয়েছে। শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনের রাস্তা, রেলগেইট, সোনালী ব্যাংক রোড, বাটার মোড় ও চিনিকল রোড়ে জুতা মেরামতকারীরা জুতা সেলাই করে জন্য ব্রাশ, ফার্মা, আলপিন, সুতা, পেরেক, বাটাল, হাতুর, কাচি, পঞ্চ, মাততুল, রানার, কৌটায় রং, বাক্সের একটি অংশে আছে চামড়াসহ কাজ করার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম। যা সাজিয়ে নিয়ে বসে আছেন রাস্তার পাশে।
আবার কেউ সকল সরঞ্জামগুলো বাক্সে সাজিয়ে কাঁধে নিয়ে ছুটে চলে শহরের অলিগলিতে। এ জেলায় জুতা সেলাইকারীর সংখ্যা ৩০০ জন। হঠাৎ কেউ তাদের পাশ দিয়ে হেটে তাকিয়ে থাকে পায়ের জুতার দিকে। কখন এসে বলবে মামা কিংবা দাদা আমার জুতাটা একটু পালিশ কিংবা মেরামত করে দেন। এমন কাঙ্ক্ষিত কথা শোনার জন্য যেন অপেক্ষার প্রহর গুনে থাকেন।
চল্লিশ বছর ধরে জুতা সেলাই করার কাজ করেন জয়পুরহাট সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নের বাসিন্দা মন্টু রবিদাস (৭০)। সবাই তাকে মন্টু বলে ডাকেন। চার ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। পিতামাতাকে পৃথক করে দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে এখন স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার।
তিনি মানুষের ছিঁড়া জুতা সেলাই করেন কিন্ত তাঁর ভাঙ্গাচোরা জীবন আর সেলাই করতে পারেন না। সেলাই করবেন কিভাবে যেখানে প্রতিদিন কাজ করে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা উপার্জন করেন। এ টাকা দিয়ে তার পরিবারের সংসার চালানো কি সম্ভব। চলমান মুদ্রাস্ফীতি ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দৈনিক জুতা সেলাই করে রোজগারের টাকা দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে উঠেছে তার।
কেমন কাটছে জীবন জানতে চাইলে মন্টু রবিদাস বলেন, আমি ছোটকাল থেকে জুতা সেলাই কাজ করি। এখন বৃদ্ধ হয়েছি কিন্তু বৃদ্ধার ভাতার কোনো টাকা পাই না। বাড়ি থেকে শহরের আসা যাওয়াতে করতে আমার খরচ হয় ৪০ টাকা। আর প্রতিদিন কাজ করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পাই। সেই টাকা নিয়ে বাজারে গেলে বাজার খরচ করতে না করতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। আমরা বাঁচব কি ভাবে?
রেলগেইটের হরি দাস বলেন, "সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫০ টাকা ইনকাম করেছি। এ টাকা দিয়ে বাজারে যে কি কিনব? সেই চিন্তায় মাথা ঘুরে। বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সংসারের খরচ ও সন্তানের লেখাপড়ার খচর চালাতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে ছেলে বুঝি পড়াশোনা করাতে পারব না। তাই ছেলে সন্তানকে শিশু শ্রমে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমরাও মানুষ আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে কিন্তু এভাবে আর কত দিন?"
জুতা সেলাইকারী কমিটির সাধারণ সম্পাদক জগদীশ রবিদাস ( ৮৪) বলেন, 'আমি পাকিস্তান আমল থেকে জুতা সেলাই কাজ করছি। কিন্তু আমার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই যেন জীবন সংকটের মধ্যে যাচ্ছে। বর্তমান দিনে ১০০ টাকা ইনকাম করে তো সংসার চালানো যায় না। মুচি সম্প্রদায়ের মানুষ কষ্টে দিনাতিপাত করছে এর শেষ কোথায়'।
জুতা সেলাইকারী কমিটির সভাপতি মনিলাল দাস ( ৫৯) বলেন, আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এ পেশায় বেশি জড়িত আছেন। এ পেশায় আমাদের জেলায় তিনশত মানুষ কাজ করেন। এ পেশা থেকে যে টাকা আসে তা নিয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়। সরকারের উচিত আমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা।
এএজেড
