প্রধান শিক্ষক নেই নওগাঁর ৩০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় 'শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্ত্বার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।' কিন্তু নওগাঁয় প্রাথমিক স্তরেই সেই শিক্ষাকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষক সংকটে। একটি-দুটি নয়, এই জেলায় প্রধান শিক্ষক নেই ৩০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এ ছাড়া ৫২০টি সহকারী শিক্ষকের পদও শূন্য এই জেলায়।
নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলায় মোট ১ হাজার ৩৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। নওগাঁ সদর উপজেলায় ২১ জন, আত্রাই উপজেলায় ৩৮ জন, ধামইরহাট উপজেলার ২৫ জন, নিয়ামতপুর উপজেলায় ১৭ জন, পত্নীতলা উপজেলায় ২৬ জন, পোরশা উপজেলায় ১৩ জন, বদলগাছী উপজেলায় ৩০ জন, মহাদেবপুর উপজেলায় ৪৬ জন, মান্দা উপজেলায় ৪২ জন, রাণীনগর উপজেলায় ৩৫ জন এবং সাপাহার উপজেলায় ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। এ জেলায় প্রধান শিক্ষক ছাড়াও ৫২০ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক শূন্যতার কারণে বিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত সহকারী শিক্ষকদের উপর বাড়তি চাপ পড়ছে। তাদেরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বেশি সংখ্যক ক্লাস নেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। অতিরিক্ত পাঠদানের পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পালন করতে হচ্ছে। এতে করে প্রধান শিক্ষক শূন্যতার কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষকের শূন্যতায় অনেকটা দায়সারাভাবে সহকারী শিক্ষকরা পাঠদানের নামে সময় পার করছেন। শিক্ষক সংকটে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পড়ালেখা নিয়েও হতাশায় রয়েছে তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনেও পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা। তাই মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দ্রুত এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদগুলো পূরণের দাবি তাদের।
রানীনগর উপজেলার কনৌজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কাইছার ইসলাম বলেন, আমার ছেলে বাড়িতে এসে প্রায় বলে কেউ স্কুলে হৈ-হুল্লোড় করলে পাশের কক্ষ থেকে শিক্ষক এসে তাদেরকে পড়া মুখস্ত করতে দিয়ে আবার সেই কক্ষে চলে যান। শিক্ষক সংকটের কারণে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করার ফলে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। এমন পরিবেশে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।
সদর উপজেলা চকএনায়েত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ইসমাইল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক না থাকায় শিক্ষাকার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা আশা করি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করবে কর্তৃপক্ষ।
নওগাঁ সদর উপজেলার চকএনায়েত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শামীমা নাছরিন বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে মোট ৩৭৭ শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষক রয়েছে ৯ জন। প্রধান শিক্ষকসহ আরও ২ শিক্ষক প্রয়োজন। তাই একসঙ্গে এত ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান করাতে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবু মো. বখতিয়ার ইনাম ববিন জানান, প্রধান শিক্ষকসহ আরও দুই শিক্ষক খুবই প্রয়োজন। এতগুলো শিক্ষার্থীর পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষক সংকটের কারণে। অভিভাবক হিসেবে দাবি করছি যেন দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
মান্দা উপজেলার চক শ্রীকৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বাদশা বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে ১৮৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক মোট ৫ জন। দাপ্তরিক কাজে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রধান শিক্ষকের খুবই প্রয়োজন।
আত্রাই উপজেলার নবাবের তাম্বু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাফিউল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করতে যত দ্রুত সম্ভব প্রধান শিক্ষক যেন নিয়োগ দেওয়া হয় সেই দাবি জানাচ্ছি।
নওগাঁ জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, জেলায় মোট ১৩৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে ৩০০টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। এ ছাড়া ৫২০ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদগুলো শূন্য থাকার বিষয়টি আমরা শিক্ষা অধিদপ্তরে লিখিতভাবে জানিয়েছি। চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে।
এসজি