প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা শারীরিক প্রতিবন্ধী রেহেনা
শারীরিক প্রতীবন্ধকতা কোনো কাজের বাধা হতে পারে না। স্বপ্ন পূরণের জন্য চাই কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মনোবল। এগুলোর উপর আস্থা রেখেই অনেকেই পৃথিবী জয় করেছেন। যাদের জন্ম দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল পরিবারকে। সমাজের একটি আলাদা অংশ ছিল যারা। বলছিলাম শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও যারা আজ সাধারণ মানুষের কাতারে সামিল হয়েছে নিজেদের যোগ্যতায়। নিজের চেষ্টা আর দৃঢ় মনোবল তাকে সাফল্যের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বলছিলাম জয়পুরহাটের শারীরিক প্রতিবন্ধী রেহেনা আক্তারের কথা।
তিনি দারিদ্র্যের কষাঘাত আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দাখিল পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে নতুন জামা বিক্রি করা স্বপ্ন বিলাসী সেই রেহেনা আক্তার দারিদ্রতা জয়ের এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে শুধু এলাকায় নয় বরং দেশের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তার জীবন যুদ্ধের দীর্ঘ সংঘাত, দারিদ্র্যগ্রস্ত জীবন আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও আজকের সফলতার কাহিনি শোনার জন্য সরেজমিনে কথা হয় জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার শিবপুর চার মাথায় অবস্থিত তার সমন্বিত কৃষি খামারের ভিতরে অতিথিদের জন্য নির্মাণাধীন টিনের ছাউনি ঘরে।
শিবপুর গ্রামের মৃত আব্দুস সামাদ আকন্দের আট সন্তানের মধ্যে রেহেনা আক্তার পঞ্চম সন্তান। ১৯৮১ সালে তাঁর ছয় বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ডান পা দিয়ে হাঁটতে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় কারণে গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশি তো দূরের কথা, পরিবারের লোকই চাইতো না সে লেখাপড়া করুক। কিন্তু তাঁর শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ, ইচ্ছাশক্তি সব বাধাকে পেছনে ফেলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় অন্য এক আলোর ভুবনে।
তিনি দুই সন্তানের জননী তারঁ বড় ছেলে আব্দুর রহমান জয়পুরহাট সরকারি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন ও তার ছোট ছেলে আব্দুর রহিমকে তিন বছর আগে নিজের কষ্টের উপার্জিত টাকা দিয়ে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রেহেনা আক্তার (৪১) ঢাকা প্রকাশকে বলেন, দাখিল পরীক্ষার ফরম পূরণ করার জন্য যে টাকার প্রয়োজন তা ধনী-গরীব, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, সমাজপতির দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও সেই টাকার ব্যবস্থা করতে পারেননি, ফিরে আসতে হয়েছে চোখের জলকে সঙ্গে নিয়ে।
নিজের অনেক কষ্টের দ্বারা অর্জিত টাকা দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বে কিনেছিলেন ৩০৫ টাকা দিয়ে নতুন জামা। শেষ সম্বল সেই জামা বিক্রি করে তার এক বান্ধবীর কাছে বিক্রি করে সেই যাত্রা কোনভাবে সক্ষম হয়েছিলেন প্রবেশপত্র হাতে নেবার ক্ষেত্রে। নিজ বাড়ি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে পরীক্ষা কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে অবস্থান করার জন্য বাড়তি খরচ মেটাতে ধার করা টাকা পরিশোধ করেছেন জাল বুনানো কাজসহ অন্যান্য হাতের কাজের পারিশ্রমিকের অর্থ দিয়ে।
বর্তমানে রেহেনা আক্তার একজন ফাজিল পাস নারী হলেও তার পড়াশোনার খরচসহ গোটা পরিবারের ভরণপোষণের অর্থের যোগান আসতো চাঁদের আলোয় বুনানো জাল বিক্রির টাকা, হাঁস-মুরগী পালন, হোমিও ওষুধ বিক্রি এবং হাতের কাজ করার অর্থ দিয়ে। ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় একই গ্রামের তার চেয়ে তিন গুণেরও অধিক বয়সী আব্দুর রশিদ মোল্লার সঙ্গে।
এক আবেগঘন পর্যায়ে রেহেনা আক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঢাকা প্রকাশকে বলেন, এ বিয়ে ছিলোনা তার জৈবিক চাহিদা কিংবা সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য। এটি ছিল কৈশোরকালীন স্বপ্ন পূরণের ভিত। পরিবার আর সমাজ থেকে নিগৃহীত জীবনের মাঝে থেকে একটা পরিচয়ের পরিচয় দেবার উপলক্ষ মাত্র।
বয়সের অধিক তারতম্য বিদ্যমান থাকায় স্বামীর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভ্রুকুটিকে আমলে না নিয়ে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস থেকে ২০০৫ সালে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১২টি সোনালি মুরগি দিয়ে ছোট পরিসরে খামার শুরু করলেও তা একসময় বড় আকার ধারণ করে।
খামারটি যখন স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে ২০১১ সালে বার্ডফ্লু রোগে তার খামারের ১৩০০ মুরগি সবগুলো মারা যাওয়ার কারণে ৫ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। মুরগি পালন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে আবার ৯ টি হাঁস দিয়ে শুরু করেন হাঁস পালন। যা পরবর্তীতে ১৭০০ হাঁসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও গড়ে তুলেছেন ৭-৮টি গরুর খামার ও প্রায় দুই শতাধিকের ওপর কবুতরের খামার।
রেহেনা আক্তার আরও বলেন, গত এক বছরে ডিম বিক্রি ছাড়াই সাড়ে ১৬০০ হাঁস বিক্রি করেছেন ৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকায়। একই বছরে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা ৮টি ছোট আকারের গরু বিক্রি করেছেন ৩ লাখ টাকায়। বর্তমানে খামারে রয়েছে ছোট আকারের ৭টি গরু। তিন বছর আগে ৬টি কবুতর দিয়ে শুরু করা কবুতরের খামারে কবুতরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ শতেরও অধিক। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার স্থানীয় বাজারে ১৫-২০ জোড়া কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করে আয় করেন ২৭০০-৩৬০০ টাকা। ইতিমধ্যে ১ হাজার হাঁসের বাচ্চার জন্য অর্ডার দিয়েছেন।
রেহেনা আক্তারের জীবনের বড় একটি সাফল্য সেই ৫ শতাংশের ছোট্ট কুটির থেকে এখন তার সম্পদ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ বিঘায় (৩৩ শতক প্রতি বিঘা)। ২০১০ সালে তার এই উদ্যমী কাজের জন্য সিটি ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার পুরষ্কৃত অর্থ দিয়ে নির্মাণ করেছেন গরুর শেড, হাঁস-মুরগির শেড। এর মধ্যে ৯৯ বছর মেয়াদি সরকারি এক একর লিজ নেওয়া খাস জমি বাদে বাকি আড়াই বিঘা জমি তার জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে কেনা।
নিজ জায়গায় লাগিয়েছেন বিভিন্ন ফলের গাছসহ প্রায় ৩ শতাধিক কলার গাছ। মৎস্য ও হাঁস পালনের রয়েছে ১৫ শতাংশের একটি ছোট পুকুর। রেহেনা আক্তার শুধু আর্থিকভাবে সফলকাম হননি, বেড়েছে তার সামাজিক মর্যাদাও। জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন সভায় তাকে ডাকা হয় যা তার সামাজিক মর্যাদা এনে দিয়েছে বলে নিজেকে এখন গর্বিত মনে করেন।
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান ঢাকা প্রকাশকে বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী রেহেনা আক্তার একজন প্রতিষ্ঠিত নারী উদ্যোক্তা। তিনি সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে তার একক প্রচেষ্টায় সম্বনিত কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ রেহেনা আক্তার। প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে করা হবে।
এএজেড