কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে, উদাসীন অভিভাবক!
গত ১০ আগস্ট বেলা ১১টা। নওগাঁর বদলগাছীর সদর এলাকায় মাইলস্টোন হাইস্কুল নামে বেসরকারি বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে। এমন সময় ১০ থেকে ১২ জন কিশোরের একটি দল স্কুলে প্রবেশ করে সরাসরি প্রধান শিক্ষকের কাছে যায় তারা। কিশোর দলটির দাবি, ওই স্কুলের এক শিক্ষার্থীকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধান শিক্ষক পুলিশকে ফোন দেন। পরে অবশ্য দলটির মধ্যেকার একজনের প্রভাবশালী বাবা এসে তাদের নিয়ে যান।
মাইলস্টোন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু জর গিফারী বলেন, বিষয়টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত হচ্ছে দেখে থানায় সংবাদ দিই। এ ছাড়াও স্কুলের মূলগেট বন্ধ করা হয়। পরে এক ছেলের বাবা এসে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে এমন কথা বলে তার ছেলেসহ অন্যদের সেখান থেকে নিয়ে যান। এমন ঘটনা বদলগাছীতে হরহামেশাই হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে অভিভাবকদের উদাসীনতায় কিশোরদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই দিন বদলগাছী পাইলট সরকারি মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রের নেতৃত্বে ১০-১২ জন কিশোর মাইলস্টোন হাইস্কুলে প্রবেশ করে। এ সময় তারা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু জর গিফারীকে চাপ দেয় তার স্কুলের এক ছাত্রকে বের করে দিতে। বিষয়টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে দেখে তিনি থানায় সংবাদ দেন। এ সময় এক ছাত্র তার বাবাকে ফোন দিলে তিনি স্কুলে ছুটে যান। বিষয়টি মৌখিকভাবে সমাধান করে তার ছেলেসহ অন্যদের সেখান থেকে নিয়ে যান। এই ছাত্রের বাবার নাম সানাউল হোসেন হিরো। তিনি উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি।
এ ঘটনার পরের দিনই পাইলট সরকারি মডেল হাইস্কুলের সকল শিক্ষকরা মিলে আট কিশোরকে আটক করেন। পরে অভিভাবকদের ডাকা হলে তারা মুচলেকা দিয়ে সন্তানদের ছেড়ে নিয়ে যান। বিষয়টি নিশ্চিত করেন বদলগাছী পাইলট সরকারি মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেশ সিংহ।
তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও স্কুলের সকল শিক্ষক মিলে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে স্কুলে আসা হয়। পরে স্কুলে থানা পুলিশের উপস্থিতিতে অভিভাবকরা মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ স্কুলের কয়েকজন ছাত্ররাও জড়িত। আমরা এ বিষয় নিয়ে বিরক্ত।
প্রধানশিক্ষক সুরেশ সিংহ আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় এমনটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া অভিভাবকদের কিছুটা উদাসীনতা রয়েছে। বর্তমানে শিক্ষকরাও ছাত্রদের শাষণ করতে ভয় পায়। এ বিষয়টি নিয়ে দ্রুত প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয়ভাবে অভিযোগ রয়েছে উপজেলা সদরের কয়েকটি স্থানে ও দোকানের সামনে স্কুল ছাত্রীদের ইভটিজিং এর মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোর বয়সী ছেলেরা। এছাড়া কিছু কলেজের ছাত্রও অন্য স্কুলের ছাত্রও আছে।
তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে উপজেলা সদরের হাটখোলা বাজারে টিনশেডের নিচে (পাইলট স্কুলের সামনে), ছোট যমুনা নদীর তীরে মন্দিরের নিচে ও নতুন হাটসহ কয়েকটা স্থানে আড্ডা দেয়। স্কুল টিফিনের সময় ছাত্রীদের বিভিন্ন ভাবে কটুকথা বলে এসব কিশোর গ্যাং। তারা তাদের ক্ষমতা জানান দিতে দলবদ্ধ ভাবে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। বেশ কয়েক বার ছোট যমুনা নদীর তীরে মন্দিরের নিচে মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিশোর গ্রুপদের বেপরোয়া আচরণে এলাকার মানুষদের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কখন কাকে কি বলে অপমান করবে ভয়ে অনেকে তাদের ধারে পাশেও যায় না।
মাইলস্টোন হাইস্কুলের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, গত কয়েকদিন আগে স্কুল ছুটি শেষে বিকেল ৪টার দিকে বাসার দিকে যাচ্ছি। মাষ্টার পাড়া মন্দিরের রাস্তার তিন মাথায় আমাকে দেখে কিশোর গ্যাংদের মাঝে কটুক্তি করে বলে আমাকে তারা পিটাবে। কথাটি শুনেও না শুনার ভান করে চলে যেতে হয়েছে আমাকে।
১০ আগস্টের ঘটনার বিষয়ে উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি সানাউল হোসেন হিরোর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, 'ওই দিন আমার ছেলে স্কুলে যায়নি। এক ছেলে মাইলস্টোন স্কুলের ভেতরে আমার ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়ে যদি কেউ আমার ছেলের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করে থাকে, তাহলে আমিও থানা এবং কোর্টে পৃথকভাবে মামলা দায়ের করবো'।
মাইলস্টোন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু জর গিফারী বলেন, স্কুল চলাকালীন যদি শিক্ষার্থীর কোনো ধরণের অঘটন ঘটে তার দায়ভার আমার ওপর চাপবে। নিরাপত্তার কথা ভেবে থানা পুলিশকে অবগত করা হলে তারা স্কুলে আসেন। তবে তার আগে অভিভাবকরা এসে নিয়ে যায় এবং অনেকে তাদের ভুল বুঝতে পারে। তবে যে ভাবে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে তা এখনই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বদলগাছী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান বলেন, এ বিষয়ে সবার আগে অভিভাবকদের সজাগ হতে হবে। এ জন্য সচেতনতার বৃদ্ধিতে অভিভাবক সমাবেশ করা হচ্ছে। আমরা তৎপর আছি এবং পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে।
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলপনা ইয়াসমিন বলেন, উপজেলায় টিনএজ (উঠতি বয়সি) বেশ কিছু ছেলেদের অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। আগামী আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তাদের সচেতনতার জন্য পুলিশ প্রশাসন এবং অভিভবাকদের সমন্বয়ে বেশ কিছু কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। তারা যেন কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে জন্য স্কাউটিং, বির্তক প্রতিযোগীতা, পড়াশুনা এবং খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. শরিফুল ইসলাম খাঁন বলেন, শ্রেণি কক্ষে উপস্থিত না থাকা এবং সন্ধ্যার পর বাসা বা বাড়ির বাহিরে থাকাটাই প্রধান সমস্যা। শ্রেনীকক্ষে উপস্থিত বাড়াতে হবে এবং সন্ধ্যার পর বাসার বাহিরে থাকা যাবে না। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের এ বিষয়টা দেখতে হবে। এটা করা গেলে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া এই কিশোরদের অবৈধভাবে কেউ অর্থের জোগান এবং বড় ভাই হিসেবে তাদের কেউ উৎসাহ দিচ্ছে কিনা দেখতে হবে। মোট কথা অভিভাবকদের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে।
এএজেড