ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস
কেমন আছেন নিহতদের স্বজনরা
২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লাখনিবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরের গুলিতে নিহত হন তরতাজা যুবক আমিন, সালেকিন ও তরিকুল। তাদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন মা-বাবা। ফুলবাড়ী আন্দোলনের ১৬ বছর পূর্তি আজ। ২৬ আগস্ট এলেই শুধু গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের কছে যান। তা ছাড়া কেউ খোঁজও নেয় না।
নিহতদের মধ্যে তরিকুল সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলেও বাঁকি দুজন আমিন ও সালেকিন ছিলেন দুস্থ ও অসহায় পরিবারের। সালেকিন ও তরিকুল ছিলেন শিক্ষার্থী। কিন্তু আমিন ছিলেন তার পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমিন ও সালেকিনকে হারিয়ে তাদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
যা ঘটেছিল সেই দিন
জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনির কয়লা উত্তোলনের চক্রান্ত বন্ধের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ওইদিন বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। ওই কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় ফুলবাড়ী সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন। কয়লাখনি এলাকা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ এই চার উপজেলার কয়লাখনিবিরোধী মানুষ দলবব্ধ হয়ে সেদিন বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এশিয়া এনার্জির কার্যালয় ঘেরাও করতে যান। ফুলবাড়ী ছোট যমুনা সেতুর পূর্বপাশে পুলিশ-তৎকালীন বিডিআর ওই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই আমিন, সালেকিন ও তরিকুল ইসলাম নিহত হন।
কেমন আছেন নিহতদের স্বজনরা
ফুলবাড়ী পৌরএলাকার বারোকোনা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে মো. আমিনুল ইসলাম। চার ভাইবোনের মধ্যে আমিনই ছিল বড়। আমিনের বাবা কৃষি কাজ করে সংসার ও ছোট ভাইবোনের পড়ালেখা চালাতেন। ১৪ বছরের কিশোর আমিন কাঠমিস্ত্রির কাজ করে বাবাকে আর্থিক সহায়তা করত। ওইদিন সবার মতো আমিনও মিছিলে বেরিয়ে পড়ে। মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু হলে আমিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
আমিনের মা রেহেনা বেগম বলেন, ছেলে দেশের মাটি রক্ষা করতে আন্দোলনে গেল কিন্তু আর ফিরে এল না। আমরা ওইদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে পাচ্ছিলাম না। পরে রাতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মরদেহ পেয়েছি। আমিন ছোট থেকেই কর্মঠ ছিল। সে পরিবারের দুর্দশার কথা চিন্তা করে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। কৃষক বাবার অর্থের পাশাপাশি তার অর্থ দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো হতো। কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে সন্তান হারিয়ে আজ আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমার বৃদ্ধ স্বামীর কষ্টের টাকায় সংসার চলছে কোনোমতে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ ও সংসারে খরচ চালানো তার পক্ষেও আর সম্ভব হচ্ছে না। আমিন মারা যাওয়ার পর ধারদেনা করে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাদের এতো কষ্টে দিন কাটাতে হতো না।
নবাবগঞ্জ উপজেলার উত্তর শাহাবাজপুর গ্রামের ঝোড়ারপাড়া গ্রামের হাসেন আলীর ছেলে মো. সালেকিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সালেকিন ছিল তৃতীয়। বড়ভাই সোলেমান, এরশাদ ও ছোট বোন হাসিনা ও সর্বকনিষ্ঠ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই শাহিন। সালেকিনের বাবা হাসেন আলী অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। ২০০৬ সালে সালেকিন সবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক জীবন শুরু করেছিল। গ্রামের সবাইকে আন্দোলনে যেতে দেখে সালেকিনও উৎসাহিত হয়ে ফুলবাড়ী আসে আন্দোলনে। চাচার সঙ্গে ফুলবাড়ী এলেও পরবর্তীতে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আন্দোলনে থাকেন। চারিদিকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে সেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সালেকিন।
আমিনের মা রেহেনা বেগম ও সালেকিনের মা শেফালী বেগম
সালেকিনের মা শেফালী বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, স্কুল থেকে ফিরেই না খেয়েই ফুলবাড়ী যায় সালেকিন। বার বার বলেছিলাম সেখানে গণ্ডগোল হবে যাস না। কিন্তু তবুও সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। পরে সালেকিন বাড়ি ফিরল ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ২০১১ সালে ধারদেনা করে মেয়ে হাসিনাকে বিয়ে দেই। বর্তমানে আমি, আমার স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছেলে শাহিন একখানে বাস করি। স্বামীর বয়স হয়েছে। কোনোমতে মানুষের বাড়িতে কাজ করে আমাদের খাওয়াচ্ছে। প্রতিবন্ধী ছেলেকে রেখে আমিও যেতে পারি না কাজে। সবাই শুধু ২৬ আগস্ট এলেই আমাদের খোঁজখবর নেয়। কেউ তো আমাদের জন্য কিছু করে না। সালেকিন মারা যাওয়ার পর অনেকে শুধু আশ্বাস দিয়ে গেছেন। আমার বৃদ্ধ স্বামী বিছানায় পড়ে গেছে আমাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।
ফুলবাড়ী পৌরএলাকার উত্তর সুজাপুর (চাঁদপাড়া) গ্রামের সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোকলেছুর রহমানের ছেলে আবু সালেহ মো. তরিকুল ইসলাম। তরিকুল রাজশাহীর নিউ গর্ভমেন্ট কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা মোকলেছুর রহমান ২০০৬ সালে পৌর কাউন্সিলর ছিলেন। এ ছাড়া চাষাবাদের পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন।
মোকলেছুর রহমান বলেন, ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার তরিকুল রাজশাহী থেকে ফুলবাড়ী আসতে চায়। পরে তার মা তহমিনা রহমান তাকে আসতে বাধা দিলেও আমি তাকে আসতে বলি। তাকে আসতে বলাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। সে যদি না আসত ফুলবাড়ীতে সেইদিন তবে আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকত। তরিকুলের বন্ধু-বান্ধবরা আজ আমাদের চোখের সামনে চাকরি করছে। আমার ছেলে থাকলে সেও আজ ভালো কোনো চাকরি করত।
এসএন