দূষণ, কৃত্রিম চর! ভালো নেই কীর্তনখোলা
ঢাকাগামী লঞ্চ ছাড়ার দৃশ্য দেখতে বরিশাল নদী বন্দরে গিয়েছিল ছোট্ট শিশু জাহানুর। বিস্ময়ভরে আলো ঝলমল বিশাল লঞ্চ ছাড়ার দৃশ্য বেশ পুলকিত করে তাকে। প্রায় ৩০ মিনিটের ব্যবধানে নদী বন্দর থেকে একে একে ৬টি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতেই পন্টুন লাগোয়া কীর্তনখোলা নদীর আসল চেহারা ফুটে ওঠে তার সামনে। চিপসের প্যাকেট, পানির উচ্ছিষ্ট বোতল, কাগজ, পলিথিন, পোড়া মবিলসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা পানিতে ভাসতে দেখে জাহানুরের প্রশ্ন ‘বাবা নদীটা এত নোংরা কেন? লঞ্চ ছাড়ার দৃশ্য দেখে আনন্দিত হওয়া শিশুটির আনন্দ ম্লান হয়ে যায় নদীতে নোংরার স্তূপ দেখে।
শুধু নদী বন্দর এলাকা নয়, নগরী সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর ৮টি পয়েন্টে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষণ করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা)। নগরীর প্রবাহমান ২৪টি খাল-দুষণে ড্রেন হয়ে গেলেও সেগুলো দিয়ে নগরীর সব বর্জ্য-ময়লা আর বড়-ছোট কলকারখানার সব কেমিক্যাল বর্জ্য মিশছে কীর্তনখোলা নদীতে। প্রতিদিন সকালে বরিশাল নদী বন্দরে ঢাকা থেকে আগত লঞ্চগুলোর হাজারো যাত্রীর উচ্ছিষ্ট সরাসরি ঝাড়ু দিয়ে ফেলা হয় নদীতে। এতে ক্রমে স্বচ্ছতা হারিয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠছে কীর্তনখোলার পানি। অথচ এই নদীর পানিতে গৃহস্থালী কাজ চলে তীরবর্তী হাজার হাজার নিম্ন আয়ের পরিবারের।
দূষণের পাশাপাশি তিল তিল করে কীর্তনখোলা গ্রাস করছে নদী খেকোরা। নদী ড্রেজিং করে সেই পলি তীরে ফেলে বিশাল বিশাল চর সৃষ্টি করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক হাজার বসতি, মাছের ঘের, ডেইরি ফার্ম, বাগানসহ অনেক কিছু। নদীর সীমানারেখায় বন্দর কর্তৃপক্ষের জমিতেও রয়েছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ধারাবাহিক অভিযান চললেও বরিশালে শুধু ‘হচ্ছে-হবে’তেই সময় পার করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরিশালের সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ব্রিটিশ আমলে ১৮০০ সালে ডিস্ট্রিক কালেক্টর হেনরি বেভারেজের উদ্যোগে কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন থেকে বরিশাল শহর রক্ষায় একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরে ওই বাঁধের উপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। যা নগরীর বান্দ রোড নামে পরিচিত। বাঁধ রোড সংলগ্ন নদীতে চর পড়তে শুরু করলে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ওই পলি অপসারণ না করে বরং মাঝ নদী থেকে পলি ড্রেজিং করে চরে ফেলে আয়তন বাড়ায়। পোর্টরোড থেকে স্টেডিয়াম হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার বিস্তৃত হয় নদী লাগোয়া চর। যে যেভাবে পেরেছে দখলে নিয়েছে চরের জমি।
আশির দশকে কীর্তনখোলা নদীর পোর্ট রোড লাগোয়া এলাকায় প্রায় ২৩ একর জমি নিয়ে জেগে ওঠে একটি চর। যার নামকরণ করা হয় রসুলপুর চর। পরবর্তী সময় ওই চর চার দলীয় জোট সরকারের সময় নদীর পলি ড্রেজিং করে চরের আয়তন বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রায় ৫০ একর আয়তনের রসুলপুর চর নানা ছুতোয় দখল করে আছে প্রভাবশালী চক্র। মাঝ নদীতে চর জেগে উঠলে সেসব চরেরও মালিকানা করে নিয়েছে অনেকে। সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল পাকা ভবনসহ বস্তি ধরনের হাজারো বসতি।
এর পাশেই কীর্তনখোলা নদীতে কৃত্রিমভাবে চর সৃষ্টি করে গড়ে তোলা হয়েছে মোহাম্মদপুর চর ও পলাশপুর চর। এসব চরে মাছের ঘের, মুুরগীর ফার্ম, বাগান, ডেউরী ফার্ম, বালুর ব্যবসা, ডকইয়ার্ড এবং ছোট ছোট ঘর নির্মাণ করে মাসিক ভাড়া আদায় করছে প্রভাবশালী চক্র। এমনকি প্লট করেও বিক্রি করা হয়েছে চরের জমি।
কৃত্রিমভাবে জেগে ওঠা দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠী চর, চরবাড়িয়ার চর এবং খোন্নারের চরও প্রভাবশালীদের দখলে। প্রশাসনের নজরদারী না থাকায় প্রতিনিয়ত দখল পাকাপোক্তসহ আয়তন বাড়াচ্ছে তারা।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, ১৯৬০ সালে বরিশাল নদী বন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভাটির সময় কীর্তনখোলা নদীর পানির স্তর থেকে স্থলভাগের দিকের ৫০ গজ জমি বিআইডব্লিউটিএর মালিকানাধীন। সিমানা প্রাচীর না থাকায় নদী বন্দরের উত্তর ও দক্ষিণে বিআইডব্লিউটিএর জমি দখলে নিয়ে ভূমিখেকো ও রাজনৈতিক মদদপুষ্টরা গড়ে তুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসত ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
সারা দেশে নদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে ধারাবাহিক উচ্ছেদ কার্যক্রম চললেও বরিশালে গত ৫ বছরে নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালের ২৩মে বরিশালে অবৈধভাবে নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধার অবৈধ দখলকারীদের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। এরপর জেলা প্রশাসন থেকে নদীর অবৈধ দখলদারদের তালিকা নদী কমিশনে পাঠানো হলেও তাদের উচ্ছেদে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বরিশাল নদী বন্দরের জমিতে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে নানা কার্যক্রম চলছে। অচিরেই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।’
নদী ও বন্দরের জমি দখলদারদের বিষয়ে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘সরকারি যে সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন জমি বা নদী অবৈধ দখল হয়েছে তাদের সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে। তারা অবৈধ দখল উচ্ছেদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তা চাইলে জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। জেলার ১০ উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে নদী-খাল-বিল জলাশয়ের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে বলে তিনি জানান।
এসও/এএন