ঝালকাঠির লঞ্চ অগ্নিকাণ্ড
দুই সন্তানসহ পরিবারের ৫ সদস্য হারিয়েছেন পুতুল
হাসপাতালের বেডে শুয়ে শারীরিক কষ্ট আর যন্ত্রণার চেয়ে দুই সন্তান হারানোর বেদনা বেশি ভোগাচ্ছে পুতুলকে। ঝালকাঠি লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও সন্তানসহ পরিবারের ৫ সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
পুতুলের দুই সন্তান জীবন (১২) এবং ইমন (৮), তার দেবর কালু এবং কালুর স্ত্রী এবং সাত বছরের সন্তান ঝালকাঠির অভিযান ১০ লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন। পুতুল নিজেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার নিজের হাত, পা এবং শরীরের পিঠের অংশ পুড়ে গেছে। শারীরিক যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি।
আগুনে পুড়ে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে গেছেন পুতুলের স্বামী রাসেলও (৩০)। পুতুল বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি এবং তার স্বামী রাসেলকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনিস্টিটিউটে মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি রাসেল। ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে রাসেল চাকরিরত ছিলো। লঞ্চ দুর্ঘটনায় দুই সন্তান, মা এবং নিজের শরীরের কোমরের অংশ হতে পুরো পা পর্যন্ত দগ্ধ হয়ে আজ তিনিও স্তব্ধ।
ঢাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) অভিযান ১০ লঞ্চে চড়ে বরগুনা জেলায় বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন পুতুলসহ পরিবারের ৯ সদস্য। গভীর রাতে লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। এ দুর্ঘটনায় ৯ সদস্যের মধ্যে ৫ জন নিখোঁজ হওয়ার পর ২ জনের লাশ শনাক্ত করা গেছে বরগুনায়। তাদের বরগুনা পুতুলের দুলাভাইয়ের বাড়িতে কবর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুতুলের ছোট দেবর রবিন সুস্থ আছেন। এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় এ পরিবারের পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই।
অগ্নিদগ্ধ পুতুল বলেন, ‘সর্বস্ব হারিয়ে বেঁচে থাকাটা বড় কঠিন। দুটি সন্তানের খোঁজ নেই। স্বামী ঢাকায় বার্ন ইউনিটে ভর্তি এবং আমি বরিশালে। এর থেকে আমার জন্য মৃত্যুও ভালো ছিল। এখনও পরিবারের ৩ সদস্য নিখোঁজ। তারা আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। আমার স্বামীর শরীর আগুনে পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, আর কোনো কাজ করতে পারবে না। কি হবে এখন? কোথায় যাবো, কে আমাকে সাহায্য করবে? আমার হারানো দুই সন্তান কই? এমন কেন হলো..হে আল্লাহ্!’
অগ্নিদগ্ধ পরিবারের ৯ সদস্যের মধ্যে পুতুলের দেবর ঢাকায় ভাসমান তরকারি বিক্রেতা কালু বলেন, ‘আমার পরিবারের আমার স্ত্রী, মা, ৭ বছরের বাচ্চা কেউ নাই। বাচ্চাটা কোলে নিয়ে লাফ দেওয়ার সময় হাত থেকে ছুটে গেছে। বাবা বলে একটা চিৎকার দিছে। আর ধরতে পারি নাই। আমার সামনে থেকে নদীতে ভাইসা গেছে আমি ওরে বাঁচাইতে পারি নাই। আমার স্ত্রী এবং মা আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেছে আমি কিছু করতে পারি নাই। আল্লাহ আমারে কেন বাঁচাইলো? আমার দুই হাত, দুই পা আগুনে পুড়ে গেছে। আমি জীবনে আর কাজ কইরা খাইতে পারমু না। এ জীবন নিয়ে কই যামু?’
পুতুলের দুলাভাই বরগুনার মিলন বলেন, ‘পুতুল, কালু এবং রবিনের পরিবার দেখার মতো কেউ নেই। আপাতত আমি হাসপাতালে দেখাশুনা করছি। কিন্তু আর দুই থেকে তিনদিন পর এই হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবে। তখন ওদের কি হবে? কে ওদের খাওয়াবে? রাসেলকে বাঁচানো যায় কিনা বলা যায় না। বাঁচলেও কোন কাজ করতে পারবে না। ওদের হয়ে সবার কাছে আমার অনুরোধ সকলে একটু সহযোগিতা করুন।’
বরিশালের সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ‘এমন র্দুঘটনায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাবার জন্য মানবিক দ্বায়িত্ব থেকে বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্ঘটনায় শিকার হওয়া মানুষের কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিতে হবে। এই মানুষগুলোর প্রতি সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বর্তমানে লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।’ বক্তব্যে লঞ্চে আধুনিক অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।
ব্রজমোহন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সযযোগী অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান খান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব লঞ্চ কোম্পানির নিতে হবে এবং পরিবারের কাউকে লঞ্চ কোম্পানিতে অথবা নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন,‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সিএসআর এর অধিকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, জনকল্যাণ ফান্ড, বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং সমাজের বিত্তবান মানুষগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।’
ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য ‘লিগ্যাল টিমওয়ার্ক’ এর আইন বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকার বিষয়টিও বক্তব্যে উল্লেখ করেন। লঞ্চ দুর্ঘটনা ঠেকাতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের প্রশংসা এবং সেই সঙ্গে উদ্যোগ সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে আইনি কাঠামোর সক্রিয় ভূমিকা বজায় রাখার বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেন।
সবশেষে দুর্ঘটনা এড়াতে যাত্রীদের মধ্যে নিরাপত্তার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে জনগণের দ্বায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এসও/এএন