রংপুরে বিষের চারা বুনছেন চাষিরা
বিকল্প লাভজনক ফসল না থাকায় অধিক মুনাফার আশায় নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও বিষবৃক্ষ তামাক চারা বুনছেন ভুট্টা ব্র্যান্ডিংয়ের জেলা লালমনিরহাটের চাষিরা। জানা যায়, কৃষিপণ্য ভুট্টাকে জেলা ব্রান্ডিং ঘোষণা করা হলেও ভুট্টার বাজারমূল্য নির্ধারণ না করা ও ভুট্টার প্রক্রিয়াজাত শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা না করায় তামাকে ঝুঁকছেন চাষিরা।
ঋণ ও বিনামূল্যে বীজ, সার-কীটনাশক সরবরাহসহ কোম্পানির কর্মীরা নিয়মিত চাষিদের মাঠ পরিদর্শন করে পরামর্শ দিচ্ছেন। তামাকের সময় নির্ধারিত মূল্যে তা বিক্রয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছে সকল তামাক কোম্পানি।
প্রতিটি তামাক কোম্পানির রয়েছে নিজস্ব চাষি, তারা জমি দেখে চাষি কার্ড দেন। তৈরি করেন চাষিদের ব্যাংক হিসাব নম্বর। তামাক পাতা বিক্রির সময় ঋণের টাকা কেটে নিয়ে চাষিদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাব নম্বরে চলে যায় তামাকের টাকা। ফলে বিক্রির নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে আগ্রহী হন চাষিরা।
রংপুর সদর উপজেলার চাষি মোতাহার হেসেন জানান, তামাক চাষ করলে তামাক কোম্পানি কীটনাশক ও চাষাবাদ খরচ হিসাবে নগদ অর্থ ঋণ হিসাবে আগাম দিয়ে থাকে। ফলে তামাক চাষে কম পুঁজি বিনিয়োগ করে ফসল ঘরে তোলা যায়। তামাক বিক্রিতেও ঝামেলা নেই। তামাক চাষে খরচ বেশি হলেও অন্য ফসলের তুলনায় মুনাফা বেশি।
তামাক ক্ষেতে ও তামাক পাতা সংগ্রহের কারণে তামাক পাতার গন্ধে কিছুদিন বাড়িতে থাকা কিছুটা কষ্ট হয়। তামাকের কাজ করলে এলার্জিজনিত কারণে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। তামাকের পাতা সংগ্রহের সময় ঘরবাড়ি, উঠোনসহ রাস্তার দুই ধারে শুকানো হয় তামাক পাতা। ফলে শিশু ও বৃদ্ধসহ পরিবারের অধুমপায়ীরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। ভোগেন নানা ধরনের রোগে। তামাক ক্ষেতে কাজ করলে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। এসব জেনেও অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষ বাড়ছে।
সরকারিভাবে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা মাঠে দেখা যায় না। উল্টো অন্য ফসলের প্রণোদনা এবং প্রদর্শনী বরাদ্দ পাচ্ছেন তামাক চাষিরা। ফলে সরকারি বরাদ্দের সার ও অর্থে আবাদ হচ্ছে তামাক। কৃষি বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তামাক কোম্পানির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তামাক চাষিদের এমন সুযোগ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যারা তামাক চাষ ছেড়ে অন্য ফসল চাষে আগ্রহী তাদের প্রণোদনা দিলে তামাক চাষ কমে আসবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
চাষিরা জানান, একই জমিতে দীর্ঘদিন তামাক চাষের ফলে তামাকের বড় বড় শিকড় জমির উর্বর শক্তি নষ্ট করে। ফলে তামাকের জমিতে অন্য ফসলের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন একই জমিতে তামাক চাষ করায় এক সময় এই জমিতে তামাকের ফলন কমে আসে। লালমনিরহাটে বার্লি জাত তামাক চাষের শুরুতে যে পরিমাণ ফলন হতো, বর্তমানে তার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ফলে এ জেলায় তামাক চাষেও লোকসানের শস্কা করেছেন চাষিরা।
নীলকর জমিদারদের মতোই তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের সঙ্গে কৌশল প্রয়োগ করে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন বলে অভিমত কিছু মানুষের। সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলেও তামাক কোম্পানির লোকজন নিয়মিত খোঁজখবর নেন। তামাকবিরোধী কোনো সংগঠন বা গণমাধ্যমকর্মীরা এলাকায় এলে তাদের সঙ্গে কথা বলার নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে।
তামাক চাষিরা জানান, তামাক চাষ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু তামাকে যেমন টাকা আসে, অন্য ফসলের তেমন টাকা আসে না। ভুট্টা ও সবজিসহ অন্য ফসলের সরকার নির্ধারিত কোনো মূল্য ধরা নেই। তামাকের বাজারের মূল্য নির্ধারিত রয়েছে। লাভজনক ফসল ও তার বিক্রির নিশ্চয়তা পেলে তামাক চাষ ছেড়ে দেবেন বলেও জানান চাষিরা। জাপান, আকিজ, নাসির, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লালমনিরহাট পাচঁটি উপজেলায় নিজস্ব বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গোডাউন করেছে। সব থেকে বেশি তামাক চাষ হয় আদিতমারী উপজেলায়। যা প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
সাপ্টিবাড়ি এলাকার চাষি নুর আলম বলেন গত বছর ১০ হাজার টাকা খরচ করে ৪০ হাজার টাকায় তামাক পাতা বিক্রি করেছেন। এ বছরও এক বিঘা জমিতে চাষ করবেন। তামাকের দুর্গন্ধে কাজ করাও বাড়িতে থাকা কষ্টকর। কিন্তু কষ্ট না করলে তো টাকা আয় হবে না। গরিব চাষি যেখানে লাভ বেশি সেটাই চাষ করেন। সরকার লাভজনক ফল দিলে তামাক ছেড়ে দেবো।
সারপুকুরের চাষি হাফেজ আলী ও তাজের আলী দুই ভাই প্রতি বছর বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেন, কিন্তু কোম্পানির নিষেধ থাকায় তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন না। ছবি তুলতে গেলেও নিষেধ করেন।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, ‘২০১৮ সালে লালমনিরহাট জেলায় তামাক চাষ বেশি হয়েছিল ৯ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। এরপর দুই বছর তামাক চাষের পরিবর্তে সবজি চাষ করে, এ কারণে তামাক চাষ কমে আসে। ২০২১ সালে তামাক চাষে আবারও ঝুঁকে পড়েছে চাষিরা। তবে আমরা তামাক ছেড়ে দিয়ে সবজি ও ভুট্রা ও পিয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি।’
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলে গত ২ বছর আগে তামাক চাষ হতো ১৩ হাজার ৭৮৭ হেক্টর জমিতে। আর ২০১৯ সালে চাষ হচ্ছে ১৩ হাজার ৫৫৭ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। এভাবে তামাক চাষ কমছে। তামাক চাষে উৎসাহিত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
এএস/এএন