যশোর শহরে ৪০ কিশোর গ্যাং সক্রিয়
ফাইল ফটো
যশোরে হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। যশোর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন মহল্লায় ৪০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে।
র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক, দারিদ্র, পারিবারিক সংকট, রাজনৈতিক আশ্রয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
যশোর কোতোয়ালি থানার তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গত ৬ মাসে শতাধিক কিশোরকে আটক করা হয়েছে। যশোর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন মহল্লায় অন্তত ৪০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেকটি গ্রুপে অন্তত ৮ থেকে ১৬ জন করে সদস্য থাকে বলে জানা যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় একই সঙ্গে ৩/৪টি গ্রুপও তৎপরতা চালাচ্ছে। আর এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িতদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সের মধ্যে।
র্যাব ও পুলিশ জানায়, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত কিশোররা দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এমনকি অপহরণ, বোমাবাজি ও হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধেও জড়িত হয়ে পড়ছে তারা। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাকু, ছুরি, রামদার মতো দেশি অস্ত্র ছাড়াও বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করছে।
যশোর কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা যায়, যশোর শহরের শংকরপুর, বকচর, খোলাডাঙ্গা, চাঁচড়া, রেলগেট, তুলোতলা, ভাতুড়িয়া, শংকরপুর বাস টার্মিনাল, রেল রোড, মুজিব সড়ক, মণিহার, উপশহর, পালবাড়ি, ধর্মতলা, খড়কি, রেল স্টেশন, বিরামপুর, নীলগঞ্জ, সিটি কলেজপাড়া, বারান্দিপাড়া, খড়কি কলাবাগান, পুলেরহাট, বিরামপুর, হামিদপুর, তেঁতুলতলা ও শেখহাটিতে গ্রুপ ভিত্তিক কিশোর অপরাধী বেশি।
শহরতলীর হামিদপুর, ঝাউদিয়া, চুড়ামনকাটি, হাসিমপুর, সুজলপুর ভেকুটিয়া, ইছালী, কিসমত নওয়াপাড়া, এনায়েতপুরে আরও কয়েকটি গ্রুপ এখন দেশি অস্ত্র চাকু নিয়ে সরব বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলাকাসহ অর্ধশত স্থানে কিশোররা গ্রুপ তৈরি করেছে। সন্ত্রাসী চক্রের উঠতি সদস্যদের সাথে যুক্ত হচ্ছে এসব কিশোররা। এরা কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আবার কখনো অন্যের হয়ে টাকার বিনিমিয়ে নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, গত দুই বছরে ২০টি হত্যাকাণ্ডসহ প্রায় শতাধিক অপরাধে কিশোর গ্যাং জড়িত ছিল। গত বছর ও চলতি বছরে যশোরের সুজলপুরের ইরিয়ান, শংকরপুরের আফজাল হোসেন, কলেজছাত্র সুলতানপুরের আব্দুল্লাহ, শংকরপুরের টুনি শাওন, উপশহরের এহসানুল হক ইমু, শংকরপুরে বিএনপি নেতা বদিউজ্জামান ধনি, খালধার রোডের পন্ডিত পুকুরপাড়ের হাবিবুর রহমান হবির ছেলে অনুরাগ ইসলাম অপু ওরফে আশিকুর ইসলাম অপু, শংকরপুরে আশ্রম রোডের ধনাঢ্য রোশনি বেগম হত্যাকাণ্ড এবং চাঁচড়া বর্মণপাড়া শ্মশান ঘেঁষা খালে ফেলে রনি হত্যাকাণ্ডের মতো চাঞ্চল্যকর এসব ঘটনার সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
বেজপাড়া সাদেক দারোগার মোড়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আসাদ, খড়কি ধোপাপাড়ার ইরফান ফরাজী, বারান্দিপাড়ার কিশোর নাহিদ ও ঘুরুলিয়ার ইউনুছ হত্যাকাণ্ডেও কিশোরদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি যশোরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরেই ৩ বন্দি কিশোরকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও ছিল শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বন্দিরা। কারণ সেখানেও বন্দি ৮ কিশোরের একটি গ্রুপ গড়ে ওঠে।
যশোর থানা ও জেলা পুলিশের মিডিয়া সেল ও র্যাব জানায়, , উল্লেখিত ২০টি হত্যাকাণ্ডে ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছাড়াও যশোর শহর ও শহরতলীর অর্ধশত স্পটে অভিযান চালিয়ে গত ছয় মাসে অন্তত ১০০ কিশোরকে আটক করেছে ডিবি ও পিবিআই।
এ ছাড়াও গত ৭ এপ্রিল রাতে যশোর সদর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ৬ জনকে আটক করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অপরহণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ ছিল। এর আগে শহরের শংকরপুর ইসহক সড়কের একটি সেলুনের সামনে একদল কিশোর নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়ার সময় ১৬ জনকে আটক করে র্যাব। তা ছাড়াও বকচরের চাঞ্চল্যকর রাকিব সরদার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বকচর, শংকরপুর, সিটি কলেজ পাড়াসহ আরও কয়েকটি এলাকার কিশোর গ্যাঙের ৯ সদস্যকে আটক করে র্যাব ৬।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক, দারিদ্রতা, পারিবারিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক আশ্রয়ের মতো ঘটনাগুলো কিশোর অপরাধের পেছনে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে পিবিআই যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন জানান, এলাকায় কার ক্ষমতা কত বেশি, কে কার সিনিয়র, কে জুনিয়র এ নিয়ে কিশোরদের মধ্যে হরহামেশাই হচ্ছে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। এমনকি হাতাহাতি ও খুনের ঘটনাও ঘটছে। কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে দরিদ্রতা, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি পণ্যের অপব্যবহার, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্টতা ও তার অনুকরণ করাকে দায়ী করছেন তিনি।
তার মতে, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে কিশোর অপরাধে জড়িত হওয়াদের সংখ্যা বেশি।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের এডি মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, যশোরের কিশোরদের অপরাধ প্রবণ হওয়ার পেছনে সাধারণত পারিবারিক অস্থিরতা, দারিদ্রতা, মাদকদ্রব্য, প্রেম সংক্রান্ত বিষাদ, সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয় ও অর্থনৈতিক সম্যসা অন্যতম কারণ।
তার মতে, কিশোর অপরাধীর বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
যশোরের প্রেক্ষাপটে কিশোররা কেন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর প্রতিকার কী এসব নিয়ে কথা হয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে। র্যাব যশোর ক্যাম্পের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট এম নাজিউর রহমান জানান, যশোরের প্রেক্ষাপটে মরণ নেশা মাদক, স্থানীয় উঠতি রাজনীতিকদের আশ্রয়, মাদক ব্যবসায়ীদের ইন্ধন, সামাজিক পারিবারিক শাসন অনেকটা কমে আসায় কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এতে করে কিশোররা সহজে বিপথগামী হয়ে উঠছে। তাই কিশোরদের রক্ষা করতে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোর উপরে জোর দেন তিনি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা মনে করেন, সচেতনতার এই কাজে র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিলিং বাড়ানোর উপরেও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এসআইএইচ