ঐতিহ্যবাহী যশোরের যশ খেজুরের রস
যশোর বাংলাদেশের একটি অতি প্রাচীন জনপদ। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে মিশরীয়রা ভৈরব নদীর তীরে এক সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রথম যশোরের গোড়া পত্তন করে। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পীর খান জাহান আলীসহ ১২ জন আউলিয়া যশোরের মুড়ালিতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। কাল ক্রমে এই স্থানেই মুরলী কসবা নামে একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
যশোর, খুলনা, বনগাঁ, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে যশোর একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৬৪ সালে গঠিত হয় যশোর পৌরসভা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম স্বাধীন হওয়া জেলাটির নাম যশোর। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলাটির নামও যশোর। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল এই জেলায় জন্ম গ্রহণ করেছে অনেক মহামানব।
যশোরের ইতিহাস ঐতিহ্য এত গৌরবোজ্জ্বল যে সেটা নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি ঐতিহ্য হলো খেজুরের রস। বহু প্রাচীনকাল থেকেই যশোর খেজুরগাছ এবং গুড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। যশোরের খেজুরের রসের ইতিহাস অনেক পুরানো। প্রতিবছর শুধু যশোরেই শীতকালে প্রায় ৫৩ লাখ কেজি গুড় উৎপন্ন হয়। বর্তমানে ৩ লাখ ৫০ হাজার খেজুর গাছ থেকে ৪১ কোটি ভাড় রস উৎপন্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে যশোর জেলায় প্রায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫০ টি খেজুর গাছ আছে। খেজুরের চারা রোপনের পাঁচ বছর পর রস আহরনের জন্য গাছ কাটা শুরু হয়। একটি গাছ থেকে ১৫-২০ বছর পর্যন্ত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে প্রায় তিন লক্ষ ৫০ হাজার গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাছির অভাব এবং চারা ছোট থাকায় বেশিরভাগ
গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। জেলায় বর্তমানে পেশাদার হিসেবে মাত্র ৪ হাজার ৩৯১ জন গাছি রয়েছেন। তারা ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত খেজুর গাছ থেকে গাছের রস সংগ্রহ করেন।
বছরের অন্য সময় তারা অন্যান্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে। ১০ বছর আগেও গাছির সংখ্যা দশ গুণ বেশি ছিল বলে জানা যায়। দিন দিন গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া আর রস জ্বালানোর জন্য জ্বালানির অভাবে বর্তমানে খেজুরের গুড় উৎপাদন অনেক কম হচ্ছে। বন বিভাগ থেকে জানা গেছে যশোরের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই খেজুর গাছ এমনিতেই জন্মে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয় খেজুরের বাগান। এখন শীতকাল তাই অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা খেজুর গাছের কদর বেড়েছে। এই গাছ এখন দিচ্ছে গাড়ো মিষ্টি রস আর এই রস জ্বালিয়ে পাতলা, ঝোলা, দানা গুড়, পাটালি তৈরি করা হয়।
খেজুরের রস এক ভাড়ের দাম ২০০ টাকা আর এক কেজি ভালো মানের পাটালি প্রায় ৩০০ টাকা। এক ভাড় দানা গুড় (৬/৭ কেজি) ১৫০০ টাকা বিক্রয় হয়। তবে কিছু অসাধু গাছি এবং ব্যবসায়ীরা রসের সাথে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করে বর্তমানে যশোরের গুড়ের বদনাম করে ফেলছে। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায় খাটি গুড় তৈরি করার জন্য প্রায় ৬০ জন চাষীকে শপথ করান যশোর জেলার তৎকালীন প্রশাসক আশরাফ হোসেন।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের, যশোর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৮৬১ সালে চৌগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাশে তাহেরপুর প্রথম খেজুর উৎপাদন কারখানা গড়ে ওঠে। প্রায় ২০ বছর চালু থাকার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৮৪ সালে পুনরায় কারখানা চালু করেন এ্যামেট এন্ড চেম্বার কোম্পানি।
১৯১০ সাল পর্যন্ত চলে খেজুর গুড়ের চিনি উৎপাদন কারখানাটি। ওই সময় চিনির জন্য দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন বণিকদল ছুটে আসতো তাহেরপুরে। বড় বড় জাহাজ ভিড়তো সেখানে। কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই গুড়, পাটালি রস রপ্তানি করা হতো। বর্তমানে কারখানা গুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শত বাধা আর প্রতিকুলতার মাঝে এখনও খেজুরের রস তার স্ব-মহিমায় ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
এএজেড