মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করায় ৩ বিদেশীকে হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া মিশন পাড়ায় ক্যাম্প বানিয়েছিল পাক বাহিনী। মূলত এই পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি পাহারা দিত স্থাণীয় কিছু রাজাকার। তারা যানবাহন থামিয়ে মানুষজনকে তল্লাশী করতো। মাঝেমধ্যে পাকসেনারাও আসত এখানে। মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দাবি করলেও পাক সেনাদের নিয়মিত যাতায়াত লক্ষ্য করা যেত এই অঞ্চলে।
১৮৫৫ সালে এখানে ক্যাথলিক মিশনারীরা ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন এই অঞ্চলে। তারা অনেককেই খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি আকর্ষিত করে ধর্মান্তরিত হন। তাদের প্রার্থনার সুবিধার্থে 'চার্চ অব আওয়ার লেডী অব দ্যা রোজারি' নামের একটা উপসনালয় স্থাপন করা হয় ১৮৮৩ সালে। এছাড়া সেন্ট লুইস নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে তারা। ১৯৭০ সালে এই অঞ্চলের মানুষের জ্ঞানার্জনের জন্য সেন্ট লুইস মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
মিশনের ফাদার কোব্বেসহ সকলেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্টপোষক। গির্জায় ছিল মুক্তিবাহিনীর অবাধ যাতায়াত। সেখবর অবশ্য রাজাকার বাহিনীর কানেও পৌঁছে গিয়েছিল। গির্জার পাশেই দুই রাজাকারকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী। তারপরই পাক মিলিটারির আগমন ঘটে গির্জায়। গির্জার সাহায্যকারীর নাম ছিল মারকো। মুসলমানদের মত বড় দাঁড়ি ছিল মারকোর।
মিশনপাড়ার নিলু মৃধা জানান, মারকো প্রতিদিন মিশনের লোকজনের জন্য খাবার আনতে যেত। মিশনের লোক হিসেবে তার বাইরে গির্জার বাইরে যাতায়াতের অনুমতি ছিল। দুই রাজাকার হত্যাকান্ডে দায়ি করা হয় মারকোকে। গীর্জার পাশে বটতলায় মারকোকে গুলি করে হত্যা করে পাক বাহিণী। পওে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশ ফেলে রাখে যায় ধানক্ষেতে।
মারকো হত্যাকাণ্ডের পর আশেপাশের অনেক গ্রামও পুড়িয়ে দেয়া পাক হানাদাররা। তখন অনেক মানুষও হত্যাকান্ডের শিকার হয়। পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল হয় পড়েন গীর্জার ফাদার ভ্যালেরিয়ান কোব্বে। মিশনের সকলকে ভারতে পাঠিয়ে নিজে থেকে যান গীর্জায়। তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ফাদার সেসি। মিশনের ত্রিশটা মেয়ের নিরাপওার দায়িত্ব নিতে হবে ফাদারকেই। দেড় হাজার খ্রিস্টানের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সকলকে তিনি ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেন।
শিমুলিয়া মিশনে পাক হানাদার কিংবা রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বিদেশিরাও রক্ষা পায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে রিলিফ প্রদানের জন্য কম্বলের গাঁট নিয়ে ভারত হয়ে ব্রিটিশ নাগরিক গর্ডন যাভেন হাজির হয়েছিলেন শিমুলিয়া মিশনে।
সাথে ছিলেন তার সাংবাদিক বান্ধবী মার্কিন নাগরিক অ্যালেন কনেট। অবৈধভাবে সীমানা পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে মিলিটারিরা তাদের মিশন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পেছনে অবশ্য অন্য কারণও ছিল। অভিযোগ ছিল তারা যুদ্ধবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম অপারেশন ওমেগার সদস্য। এজন্য ৭১ এর অক্টোবরে গ্রেপ্তার করে দুইবছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অবশ্য ৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পরে মুক্তিবাহিনী তাদের মুক্ত করে দেয়।
ইটালির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান শিমুলিয়া মিশনের ফাদার মারিও ভেরোনেসি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে মর্মান্তিকভাবে শহিদ হওয়া একজন ত্যাগী মানুষ। মানবসেবায় তিনি নিজেকে এমনভাবে ব্রত রেখেছিলেন শিমুলিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ তাকে ডাকতো সাধু ফাদার। ৫৮ বছর বয়সী ভেরোনেসি কোব্বে ২৮ বছর ধরে ধর্মীয় কাজে ১৯ বছরই কাটিয়েছিলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মানুষের উপরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের খবর পেয়ে তিনি চলে আসেন যশোর সদরের গির্জায়।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে থাকেন আর এক ইটালিয়ান ডাক্তার ফাদার মারিয়ো যশোর ফাতেমা হাসপাতালে। চারিদিকে বোমা, গুলি কিংবা যুদ্ধের সকল ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করে তিনি বাংলার দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সাহায্য দিতেন। গোপনীয়তার মধ্যেও পাক হানাদার বাহিনীর চোখে পড়েন তিনি। ৭১ এর ৪ এপ্রিল রবিবার পাম সানডে, গীর্জায় আশ্রয় নেয়া মানুষের সেবা করছিলেন ফাদার মারিয়ো।
ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর বুটের শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তিনি। প্রতিরক্ষার ভঙ্গীতে দুই হাত উঁচু করে বলেছেন থামো, আমার জীবন প্রদিপ জ্বলন্ত থাকতে এদের কোন ক্ষতি হতে দেবনা। সৈন্যরা কোন কথা না শুনে তাকে গুলি করে ঝাঁজরা করেদিল তার বুক। বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন ভিনদেশী ইটালিয়ান ধর্মযাজক ফাদার মারিয়ো। প্রথমে তাকে যশোরে দাফন করা হলেও পরবর্তীকালে তার কফিন শিমুলিয়ায় আনা হয়।
মারকো, ফাদার মারিয়ো ভেরোনেসি, ফাদার ভ্যালেরিয়ান কোব্বারা নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া মিশন। ধর্ম প্রচার চলে এখানে আজও, হয় উপসনা। পুরানো বিল্ডিং ছাড়াও এখানে গড়ে উঠেছে নতুন ভবন। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টান স¤প্রদায়ের বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে বসে মেলা, লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে শিমুলিয়া মিশন।
এএজেড