সরকারি স্কুলে ভর্তির চাহিদা থাকলেও ফাঁকা হোস্টেলের অর্ধেক সিট
টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির চাহিদা কয়েকগুণ বেশি থাকলেও ফাঁকা পড়ে আছে হোস্টেলের অর্ধেক সিট। বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৩৬০টি আসনের বিপরীতে ৭ হাজার ৬৭৯ জন আবেদন করেছে। ৮ম শ্রেণির শূন্য ১৮টি আসনের বিপরীতে আবেদন করেছে ১ হাজার ৬৯২ জন শিক্ষার্থী।
এছাড়াও বিদ্যালয়ে ভর্তি ছাত্র সংখ্যা ১ হাজার ৮০৩ জন। হোস্টেলের ৩২টি সিটের মধ্যে ১৬টিই খালি। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোস্টেল সুপার, বাবুর্চি, হোস্টেল বয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকাসহ অভিভাবকদের ছাত্র পথভ্রষ্ট হওয়ার শঙ্কাই হোস্টেল সিট ফাঁকা থাকার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ১৮৮০ সালে ৫২৪ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়। এটি টাঙ্গাইল পৌর শহরে অবস্থিত। পরে ১৮৮০ সালের ৩ এপ্রিল কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী টাঙ্গাইলের একটি সাধারণ বিদ্যালয়কে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করেন।
ওই সময়কার ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক গ্রাহামের নামে এর নামকরণ হয় গ্রাহাম ইংলিশ হাই স্কুল। পাঁচ বছর বিদ্যালয়টি অর্থ সমস্যার ভেতর দিয়ে পরিচালিত হওয়ার পর আর্থিক সুবিধার জন্য টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নবাব বাহাদুর নওয়াব আলী চৌধুরী কাছে বিদ্যালয়টি দেওয়া হয়। জমিদার দুই বছর বিদ্যালয়ের পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করেন।
এরপর ১৮৮৭ সালে টাঙ্গাইলের সন্তোষের ভূম্যধিকারিণী বিন্দুবাসিনী রায় চৌধুরানী বিদ্যালয়টি পরিচালনার ব্যয়ভার নেন। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। ১৯১০ সাল পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করেন তিনি। ওই বছর ট্রাস্ট গঠন ও ট্রাস্ট সম্পত্তি আকারে তা সরকারের কাছে দেওয়া হয়। এরপর বিদ্যালয়টি সরকারি অর্থসহায়তায় পরিচালিত হয়।
বিন্দুবাসিনী রায় চৌধুরানীর মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে জমিদার প্রমথ নাথ রায় চৌধুরী ও মন্মথ নাথ রায় চৌধুরী বিদ্যালয়ের স্থান, উদ্যান, নিউ মার্কেটসহ ছাত্রাবাস ও স্টেডিয়াম সংলগ্ন পুকুরের জায়গা বিদ্যালয়ের নামে দান করেন এবং বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করেন।
১৯৭০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৯১ সালে বিদ্যালয়ে প্রভাতী ও দিবা শাখা নামে দ্বৈত শিফট চালু করা হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি বাংলাদেশের সেরা উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ার খেতাব অর্জন করে। বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং পরে তারা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেয়।
এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে টিনশেড ও একতলা বিশিষ্ট কক্ষে হোস্টেল কার্যক্রম চালু থাকলেও ২০০৫ সালে দ্বিতল বিশিষ্ট ৩২ শষ্যার একটি পাকা হোস্টেল ভবন উদ্বোধন করেন তৎকালীন টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। বর্তমানে হোস্টেলের সিট বাবদ মাসিক ভাড়া ১ হাজার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ আনুশঙ্গিক ১ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া জনপ্রতি ছাত্রের খাওয়া বাবদ খরচ লাগছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রের সংখ্যা ১ হাজার ৮০৩ জন। বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সংখ্যা ৩৭৭ জন। এর মধ্যে প্রভাতী শাখা ১৮৫ আর দিবা শাখায় ১৯২ জন। সপ্তম শ্রেণির মোট ছাত্র সংখ্যা ৩৪১ জন।
এর মধ্যে প্রভাতী শাখায় ১৭৯ আর দিবা শাখা ১৬২ জন। অষ্টম শ্রেণির মোট ছাত্র সংখ্যা ৩৬৭ জন। তারমধ্যে প্রভাতী শাখায় ১৮৩ আর দিবা শাখায় ১৮৪ জন। নবম শ্রেণির মোট ছাত্র সংখ্যা ৩৬০ জন। এর মধ্যে প্রভাতী শাখায় ১৭৯ আর দিবা শাখায় ১৮১ জন। দশম শ্রেণির মোট ছাত্র সংখ্যা ৩৫৮ জন।
এর মধ্যে প্রভাতী শাখা'য় ১৭৯ আর দিবা শাখা'য় ১৭৯ জন। এছাড়াও আগামী বছর বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তির ৩৬০টি আসনের বিপরীতে ৭ হাজার ৬৭৯ আর অষ্টম শ্রেণির শূন্য ১৮টি আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৬৯২টি। প্রতিটি কক্ষে ও পৃথক সিটে চারজন করে ছাত্র থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। থাকার বিছানা, পোশাক রাখার ব্যবস্থা ও পড়ার টেবিলও ভিন্ন ভিন্ন রাখা হয়েছে। কক্ষে ফ্যানসহ রয়েছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সুবিধা।
হোস্টেলে থাকা ছাত্র তাসিন আহাম্মেদ। সপ্তম শ্রেণির এ ছাত্রের বাড়ি গাজীপুর জেলায়। সে জানায়, দুই বছর ধরে হোস্টেল থেকে লেখাপড়া করছে সে। হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারের আচার আচরণসহ থাকার পরিবেশ ও খাওয়া-দাওয়ার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও মাঝে মাঝে অভিভাবকরা এসে তার খোঁজখবর নিয়ে যান বলে জানায় সে।
হোস্টেলে অবস্থানরত বাসাইল উপজেলার ময়থা গ্রামের বাসিন্দা ও বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র বিশাল চন্দ্র সরকার জানায়, গ্রাম থেকে এসে বিদ্যালয়ে লেখাপড়া সম্ভব হচ্ছে না বলে ছয় মাস আগে হোস্টেলে উঠেছে। হোস্টেলে জনপ্রতি ছাত্রের ৫ হাজার টাকার মতো খরচ লাগছে।
হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার মো. ফারুক হোসেন জানান, ২০১৭ সাল থেকে হোস্টেল সুপার হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। সরকারিভাবে হোস্টেল সুপার, বাবুর্চি, হোস্টেল বয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত হোস্টেল সুপার না থাকায় অভিভাবকদের মাঝে শঙ্কা কাজ করে। এ কারণেই হোস্টেলে ছাত্র সংখ্যা কম। হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্ররা বেশ সংগঠিত। হোস্টেলে ভালো পড়ালেখাও হয়। বিগত সময়ে বুয়েটে চান্স পাওয়াসহ এসএসসি ও জেএসসিতে স্কলারশিপ পাওয়ার রেকর্ডও আছে এ হোস্টেলের।
তিনি জানান, হোস্টেলের কোনো ছাত্র বিপথে গেছে এমন রেকর্ড নেই। এছাড়া বিদ্যালয়ের সব শ্রেণির পরীক্ষায় হোস্টেলের ছাত্রদেরই ভালো রেজাল্ট করতে দেখা গেছে। হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্রদের জন্য রয়েছে কমনরুম ও খেলাধুলার সুবিধা। হোস্টেল সিট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ জনপ্রতি ছাত্র ১ হাজার টাকা খরচ দিচ্ছে। এছাড়া নিজেদের খাবার খরচ ছাত্ররাই বহন করছে।
এ বিষয়ে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল করিম জানান, সরকারিভাবে হোস্টেল ভবন নির্মাণ ছাড়া কোনো ধরণের বরাদ্দ দেওয়া হয় না। হোস্টেলের উপার্জন দিয়েই রক্ষণাবেক্ষণ করাসহ অবস্থানরত ছাত্রদের সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিবেশ সচল রাখা হয়েছে। বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে হোস্টেল সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ছাত্রদের তত্ত্বাবধান চলছে। সন্তানের পড়ালেখার জন্য অনেক অভিভাবক শহরে বাসাভাড়া নিয়েও বসবাস করেন। এ কারণেও হোস্টেলে ছাত্র সংখ্যা কম।
এএজেড