নদী তীরবর্তী ১৯ গ্রামে ভাঙনের আশঙ্কা
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণের কাজে ড্রেজার বসিয়ে পাশের নিউ ধলেশ্বরী নদী থেকে বালু-মাটি এনে ভরাট করা হচ্ছে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে নদী তীরবর্তী ১৯টি গ্রামে ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। নদী ভাঙনের আশঙ্কায় থাকা গ্রামগুলো হলো- মধ্যে- কুর্শাবেনু, জোকারচর, কদিমহামজানী, সল্লা, দশকিয়া, হাতিয়া, আনালিয়াবাড়ী, মগড়া, ধলাটেংগর, হায়াতপুর, পাথাইলকান্দি, কুড়িঘড়িয়া, হিজুলী, এলেঙ্গা, বাঁশি, বড়বাসালিয়া, পৌলী, ফটিকজানী ও মহেলা।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর থেকে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলার যোগাযোগের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কটি পরিগণিত হয়। এতে মহাসড়কে গাড়ির চাপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যানবাহনের তুলনায় মহাসড়কটি সম্প্রসারিত না হওয়ায় প্রায় প্রতিদিন যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। বিশেষ করে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। জনগুরুত্ব বিবেচনা ও প্রতিনিয়ত যানজট-দুর্ঘটনারোধে সরকার মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প হাতে নেয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও বর্তমানে মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত সহজেই যানবাহন চলাচল করছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনার হারও অনেক হ্রাস পেয়েছে।
তবে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত দুই লেনের মহাসড়কে ভোগান্তি রয়েছে। প্রায়ই যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনায় তাজা প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনগুলো নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না। এ জন্য যানবাহন ও জনসাধারণের ভোগান্তি লাঘবে সরকার নতুন করে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রায় ৬০১ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেন করার প্রকল্প গ্রহণ করে প্রশাসন।
এলেঙ্গা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চার লেনের দুই পাশে সার্ভিস লেন (এসএমভিটি) থাকলেও এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত দক্ষিণপাশে একটি সার্ভিস লেন (এসএমভিটি) করার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে মহাসড়কের উত্তর পাশের ওই অংশে রেল লাইন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সড়ক সংযোগ প্রকল্প (প্যাকেজ-৫) ফেইজ-২ এর অধীনে আইনি প্রক্রিয়া শেষে এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড। প্রায় ৬০১ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের ১৩ দশমিক ৬ কিলোমিটারের মহাসড়কে একটি ফ্লাইওভার, ৮টি ব্রিজ, ১০টি কালভার্ট ও দুইটি আন্ডারপাস এবং একটি সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। আগামী ২০২৪ সালে জুন মাসে কাজটি শেষ করার কথা রয়েছে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটির (ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) পরিমাপ করে ২১টি লটে চার কোটি দুই লাখ ২৬ হাজার ১৫৩ ঘনফুট বালু ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটারিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
উত্তোলন করা এই বালু-মাটির বেশিরভাগ কালিহাতী উপজেলার সীমানায় থাকায় উপজেলা প্রশাসনকে দরপত্র আহ্বানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই লক্ষে কালিহাতী উপজেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটারিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে দুই দফায় দুটি দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা ওই দরপত্রে অংশ নিয়ে নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটি (ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) কিনে নিয়ে চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) পেয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে। দিন-রাত পাইপযোগে মহাসড়ক নির্মাণের জন্য বালু-মাটি ফেলা হচ্ছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটি (ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) প্রশাসনের সহায়তায় স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রয় করে। পরে এলাকার প্রভাবশালীদের সহায়তায় মহাসড়কে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে। আর এ কাজটি করতে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সখ্যতা গড়ে উঠে।
এদিকে এ সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী সাধারণ মানুষের আবাদি জমির মাটি ক্রয় করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মহাসড়ক ভরাটে লাগাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা বালু-মাটি বিক্রি করতে গিয়ে কালিহাতী উপজেলার কুর্শাবেনু ও কদিম হামজানি মৌজায় নিউ ধলেশ্বরী নদীর পাশে সমান্তরাল প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ আরও একটি কৃত্রিম নদী খনন করে ফেলেছে। এতেও মহাসড়কে মাটি ভরাট সম্পন্ন না হওয়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাব-ঠিকাদার নিযুক্ত করে। সাব-ঠিকাদার বালু ব্যবসায়ীরা নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীরের জমির মালিকদের অর্থের প্রলোভনে ফেলে মাটি কেটে নিয়ে মহাসড়কে ফেলছে। আগামী জানুয়ারি মাসে নিউ ধলেশ্বরী নদীতে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে মাটি-বালু উত্তোলনের পায়তারা করছে। এর ফলে বর্ষা মৌসুমে নিউ ধলেশ্বরী নদীর ডান ও বাম তীরের ১৯টি গ্রামে নদী ভাঙনের আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা জানান, তারা ৯০ লাখ ঘনফুট বালু-মাটি উপজেলা প্রশাসনের দরপত্রের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ক্রয় করেছেন। এর বাইরেও স্থানীয় অনেকে বালু-মাটি প্রকল্পের মাটি ভরাটের জন্য দিচ্ছেন। তারা তা ন্যায্য মূল্যে কিনে নিচ্ছেন। তবে তারা ড্রেজার বা নদীর তীরের পাশে গভীরতা সৃষ্টি করে কোনো বালু-মাটি নিচ্ছেন না।
তারা আরও জানান, স্থানীয় লোকজন তাদের নিজস্ব সম্পত্তি থেকে বালু-মাটি কেটে বিক্রি করলে তাদের কিছু করার নেই। এ ছাড়াও বৃহত্তর স্বার্থে উন্নয়নের জন্য কিছুটা ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে।
এ ব্যাপারে এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম খান জানান, তাদের দায়িত্ব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া। তারপরও প্রকল্পে মাটি ভরাট করতে গিয়ে ঠিকাদারের কারণে যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই বিষয়ে তিনি লক্ষ্য রাখবেন। প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এসআইএইচ