১২ ডিসেম্বর ভোরে শ্রীপুরে উড়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা
আজ ১২ ডিসেম্বর, গাজীপুরের শ্রীপুর মুক্ত দিবস। ধর্ষণ, গণহত্যা, বসতভিটায় অগ্নিসংযোগ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের হত্যা, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে শ্রীপুর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। শ্রীপুর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের যোগাযোগের জন্য রেলপথ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণে টিকতে না পেরে ১২ ডিসেম্বর ভোর রাতের মধ্যেই শ্রীপুর ছাড়তে শুরু করে পাক হানাদার বাহিনী এবং আত্মগোপনে চলে যেতে থাকে রাজাকাররা। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযু দ্ধের মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর শ্রীপুর উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে শ্রীপুরের ইজ্জতপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কিশোর সাহাব উদ্দিন। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় ৩ রাজাকার ও একজন পাকসেনা নিহত হয়েছিল। সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, পাকিস্তানি ক্যাম্পে নারী ধর্ষণ, মুক্তিযোদ্ধার বাবা, ভাই, আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করে গণকবর দেওয়া, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা।
শ্রীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সিরাজুল হক বলেন, ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল হানাদার বাহিনী শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। পাক সেনারা শ্রীপুর থানা, গোসিঙ্গা কাচারি বাড়ি, কাওরাইদ রেলস্টেশন, সাতখামাইর রেলস্টেশন, ইজ্জতপুর ব্রিজ, কাওরাইদের গোলাঘাট রেলব্রিজ ও বলদি ঘাট উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্থানে ৮টি ক্যাম্প গড়ে তুলে। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস থেকে ট্রেনযোগে শ্রীপুর অঞ্চলে পাক হানাদারদের ছিল সহজ যোগাযোগ। শ্রীপুর থানায় ছিল হানাদারদের প্রধান ঘাঁটি। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী নিরীহ নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত।
বাবার লাশটিও পেলেন না
শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া (আকন্দবাড়ী) গ্রামের শহীদ সাদির আকন্দের দ্বিতীয় ছেলে পীরজাদা শাহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান আকন্দ জানান, ১৯৬৫ সালে তার বাবা তৎকালীন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। তরুণ যুবকদের প্রশিক্ষিত করে তোলার ভয়ে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের চিহ্নিত করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গী অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের সামনে ফজরের নামাজ শেষে তার বাবা বাসায় ফিরছিলেন। তখন দেশে কারফিউ চলছিল। ওই অবস্থায় তার বাবা পাক সেনাদের হাতে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। কথোপকথনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে তার পরিচয় পাওয়ার পর ৭টি বুলেটের আঘাতে পাকিস্তানি সেনারা টঙ্গীর অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের সামনে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। সবশেষে তার লাশটিও রেখে যায়নি হানাদাররা। স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খুঁজে আজও তার সন্ধান পাননি।
১০ জনকে বেঁধে এনে ব্রাশ ফায়ার
শ্রীপুরের সাতখামাইর গ্রামের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, এ গ্রামের হারেছা খাতুনের স্বামীকে পাকিস্তানি সেনারা তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তার স্বামীর সঙ্গে একই এলাকার ইউসুফ আলী, আজম আলী, আব্দুল লতিফ, গিয়াস উদ্দিন, ছসু মোল্লাসহ ১০ জনকে হত্যা করে সাতখামাইরে গণকবর দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে সাত মাসের সন্তানসম্ভবা সালেহা এবং শিরীন নামে এক তরুণীকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে শ্রীপুরের জিনেজানের রেলসেতুর কাছ থেকে তাদের মাথার চুল, কঙ্কাল এনে গণকবরে সমাহিত করা হয়।
বধ্যভূমিতে ১২ জনের দেহ
শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজ মাঠের একপাশে ১২ জন শহীদের গণকবর রয়েছে। শ্রীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সিরাজুল হকের ভাষ্য, কেওয়া আকন্দবাড়ীর নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানিরা বাড়ি থেকে তার বাবা ফকির আলমগীর বাদশা আকন্দকে ধরে এনে হত্যা করে। তার বাবার সঙ্গে উজিলাবর গ্রামের ওমর আলী প্রধান, আব্দুছ ছামাদ, লিয়াকত আলী মিঞাসহ আরও কমপক্ষে ১১ জনকে হত্যার পর গণকবর দেওয়া হয়।
শহীদ হন সাহাব উদ্দিন, নিহত হয় ৪ রাজাকার ও এক পাক সেনা
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের বর্ণনা মতে, ৭ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় ফায়ারের শব্দ শোনার পর পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়। পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির শব্দে আশপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধারা দুদিক থেকেই পাক সেনাদের উপর আক্রমণ করতে থাকে। চলতে থাকে গুলি বিনিময়। শ্রীপুরের খোঁজেখানী এলাকার বাসিন্দা ও গোসিঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সাহাব উদ্দিন ছিল রেলসেতুর পূর্ব পাশে থাকা দলের সামনের সারিতে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন সাহাব উদ্দিন। নিহত হয় একজন পাকিস্তানি সেনাসহ ৪ রাজাকার।
১২ ডিসেম্বর রাজাকার ও শত্রুমুক্ত হয় শ্রীপুর
শ্রীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৭ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় ইজ্জতপুরে রেলসেতু ধংস করা হয়। এরপর থেকেই পাকিস্তানি সেনারা শ্রীপুরের বিভিন্ন ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাওয়া শুরু করে। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর সম্পূর্ণরূপে রাজাকার ও হানাদারমুক্ত হয় শ্রীপুর। ১১ ডিসেম্বর রাতের মধ্যে শ্রীপুর ছাড়তে শুরু করে রাজাকার ও হানাদাররা। ১২ ডিসেম্বর ভোরে শ্রীপুর সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে শ্রীপুর হাসপাতালের সামনে প্রথম উড়ে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা।
এসজি