পৌরসভার বর্জ্যে দুর্ভোগের শিকার হাজারো মানুষ!
মাদারীপুর পৌরসভার দৈনিক প্রায় ৩৫ টন বর্জ্য ফেলার জন্য নিজেস্ব কোন ভাগার বা ডাম্পিং স্টেশন নেই। এ কারণে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে পৌরসভার সমস্ত বর্জ্য মস্তফাপুর ইউনিয়নের বড়মেহের এলাকার ঢাকা-বরিশাল মাহসড়কের পাশেই ফেলা হচ্ছে। এতে ওই এলাকার অন্তত ৫ শতাধিক পরিবার রোজ দুর্গন্ধ সহ্য করে বসবাস করছেন। একই সঙ্গে পথচারী ও যানবাহনের যাত্রীদেরও দুর্গন্ধ সহ্য করতে হচ্ছে।
এদিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে ময়লা-আবর্জনার বিশাল স্তূপ গড়ে ওঠায় প্রায় ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। গত ১ বছরে এই এলাকায় তিন জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা বলছেন, ময়লার স্তূপে পেট্রোল দিয়ে পোড়ালে পুরো সড়ক ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ফলে মোটরসাইকেল আরোহীরা সামনে চোখে দেখতে না পেয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন।
মাদারীপুর পৌরসভা সূত্রে জানায়, প্রতিদিন পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড থেকে প্রায় ৩৫ টন বর্জ্য হয়। বিপুল পরিমান এই বর্জ্য ফেলার জন্য পৌরসভার নিজেস্ব জমি না থাকায় ভাগার বা ডাম্পিং স্টেশন করা সম্ভব হয়নি। গত পাঁচ বছর আগে মাদারীপুর শহরে প্রবেশমুখ শেখ হাসিনা মহাসড়কের খাগদী বাসস্ট্যান্ড এলাকা ফেলা হত পৌরসভার সমস্ত বর্জ্য। দুর্গন্ধ চারপাশ ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় লোকজনের চাপের মুখে পড়ে পৌর মেয়র।
বছর দুই পড়ে খাগদী এলাকায় ময়লা ফেলা বন্ধ করে পৌর এলাকার পাশ্ববর্তী খোয়াজপুর ইউনিয়নের পুরাতন ফেরিঘাট এলাকায় একটি খোলা জায়গায় দুই বছরের জন্য দুই লাখ টাকায় ভাড়া নেয় পৌরসভা। কিন্তু দুই মাস ময়লা-আবর্জনা ফেলার পর সেখানেও ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন পৌর মেয়রকে বাঁধা দিলে চাপের মুখে ওই স্থানেও পৌরসভার বর্জ্য ফেলা বন্ধ হয়ে যায়।
সবশেষ গত দুই বছর ধরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মস্তফাপুর ইউনিয়নের বড়মেহের এলাকায় পৌর মেয়র খালিদ হোসেনের নিজস্ব তিন একর জমির কিছু অংশে ময়লা ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমানে মহাসড়কের দুইশ মিটার অংশ ঘেঁষে পৌরসভার বর্জ্য রোজ ফেলা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বড়মেহের এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ২৪ ফুট চওড়ার মধ্যে দেড় থেকে দুই ফুট চলে গেছে ময়লার দখলে। মহাসড়কের দুইশ মিটার অংশ নাকে-মুখে হাত চেপে, নিঃশ্বাস বন্ধ করেও পথচারী বা যাত্রীরা পারাপার হচ্ছেন। দুর্গন্ধ বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছেন চারিপাশের বাসা বাড়িতে। বিশাল ময়লা স্তূপে তীব্র দুর্গন্ধ থাকায় সবচে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন মস্তফাপুর ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার।
এ ছাড়াও ময়লার স্তূপের দক্ষিণ পাশেই রয়েছে একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এখানে থাকা শিক্ষার্থীরা দুর্গন্ধ নাকে নিয়েই পড়ালেখা করতে হচ্ছে। এ স্তূপের দক্ষিণ পাশে দুটি মসজিদ, পশ্চিম পাড়ে বড় পুকুর পাড় মসজিদ ও উত্তর পাড়ে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ময়লার স্তূপ থেকে ২০ মিটার দূরেই রাজমিস্ত্রি দেলোয়ার ব্যাপারী (৫৫) ও তার স্ত্রী নূর নাহার বেগম (৪৫) বসবাস করেন। দুবছরের বেশি সময় ধরে এই দুর্গন্ধ সহ্য করে আসছেন তিনি। দেলোয়ার ব্যাপারী ঢাকা প্রকাশকে বলেন, আমার জমিতে তিন জন ভারাটে ছিল। এখন একজনও নাই। দুর্গন্ধের যন্ত্রণায় সবাই চলে যায়। নিজের বাড়িঘর বিধায় আমরা অসহ্য যন্ত্রণা সয্যকরে এখানে টিকে আছি। রেহাই চাই আমরা। এখানে দূর থেকে আইসা কেউ একদিনও থাকতে পারবে না। আমাদের এই কষ্ট সবাই খালি দেহে কিন্তু কেউ তো আর ময়লাগুলা সরাইয়া নেয় না।
বড়মেহের এলাকার মো. জাহিদুল আলম বলেন, লোকালয়ের মধ্যে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে আমরা এক বছর আগে ডিসি স্যারের (জেলা প্রশাসক) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোন লাভ হয় নাই। এলাকার লোকজন একবার পৌরসভার ময়লার গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়া দেয়। তবুও তারা এখানেই ময়লা ফেলে পুরো পরিবেশটা নষ্ট করে দিছে।
মস্তফাপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. হাবিব হাওলাদার ঢাকা প্রকাশকে বলেন, মাঝে মধ্যেই ময়লার ভাগারে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন ব্যস্ততম রাস্তাটি ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর এ সময় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এ পর্যন্ত এখানে ৪ জন লোক দুর্ঘটনায় মারাই গেছে। আর ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই কম বেশি ঘটে।
যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলায় মস্তফাপুর এলাকার শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানায় দুর্গন্ধের শিকার বাসিন্দারা। এ সম্পর্কে পৌরসভার চিকিৎসা কর্মকর্তা হরষিত বিশ্বাস ঢাকা প্রকাশকে বলেন, খোলা স্থানে বর্জ্য ফেলার ফলে ওই এলাকার মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ওই এলাকায় মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ছে। এসবের কারণে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মস্তফাপুর এলাকা থেকে বর্জ্য ফেলা অতি শিগগিরি বন্ধ করার উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে।
মাদারীপুর পৌরসভার পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার আবু আহমদ ফিরোজ ইলিয়াস ঢাকা প্রকাশকে বলেন, পৌর বর্জ্য ফেলার জন্য আমাদের নিজেস্ব কোন জমি নাই। পৌরসভার মধ্যে ও আশেপাশে যেখানেই ময়লা ফালাই স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়ে সরে আসতে হচ্ছে। তাহলে পৌর ময়লা আমরা কোথায় ফেলবো? এ কারণ পৌর মেয়র তার নিজের ক্রয় করা জমিতে বাধ্য হয়ে ময়লা ফেলছে। যদিও সেটা ইউনিয়নের মধ্যে। সেখানের মানুষও দুর্গন্ধে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। তারা প্রায়ই আমাদের ময়লার গাড়ি বাঁধা দেন।
এএজেড