একই পরিবারের ৮ জন দৃষ্টিহীন, বাঁচতে চান খেয়ে-পরে
প্রথমে বাবা এবং একেক করে সন্তান ও তার নাতিরাও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মেছেন। এখন ওই পরিবারের আটজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। দিনের এক বেলায় খেতে পারলে আরেক বেলায় খাবার থাকে না ঘরে। সরকারিভাবে পাওয়া মাসিক ভাতা ১৫ দিন পর শেষ হয়ে যায়। প্রতিবন্ধী হওয়ার এই সংকট থেকে পরিবারটি যেন বের হতে পারছে না। মাঝেমধ্যে অর্থ সাহায্য পেলেও চিকিৎসা সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসেনি কখনো।
গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার উজিলাব (হলাটিরচালা) এলাকার হোসেন আলী এখন প্রয়াত। গত ২০২০ সালে তিনি মারা যান। তার একটি চোখে তিনি কিছুই দেখতেন না। আমৃত্যু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও দুই কন্যা রেখে যান। তারাও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী রাশিদা অনেক কষ্টে সন্তানদের বড় করেন এবং প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেন। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুরাও জন্মান্ধ। বংশ পরমপরায় অন্ধত্বের হাত থেকে রেহাই পাবে কিনা তা নিয়ে তারা শংকিত। তাদের চিকিৎসায় কেউ এগিয়ে আসলে এ গ্লানি মুছে যাবে বলেও স্বপ্ন দেখেন তারা। এ জন্য বাধ্য হয়ে সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা চেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
পরিবারের একমাত্র সুস্থ নারী মৃত হোসেন আলীর স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, স্বামী মারা গেছে ২০০০ সালে। স্বামীর এক চোখে সমস্যা ছিল। মারা যাওয়ার সময় জন্মান্ধ দুই ছেলে ও দুই কন্যা রেখে গেছেন। তাদের লালন-পালন করে বড় করেন এবং বিয়ে দেন। এখন তাদের ঘর থেকে জন্মগ্রহণ করা শিশুরাও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করছে। কোনও দিন ভাত মিললে খাওয়া হয় না মিললে না খাওয়া অবস্থায় চলছে।
হোসেন আলীর বড় ছেলে আমীর হোসেন বলেন, ‘আমার কোনও উপার্জন নাই। এক বেলা খাইতে পারলে আরেক বেলা খাইতে পারি না। একটি বাউল গানে ঢোল বাজাতেন। প্রতিবন্ধী হওয়ায় মানুষজন সাধারণত নিতে চায় না। এখন আবার পায়ে সমস্যা হওয়ায় বেশি সংকটে পড়েছেন। প্রতিবন্ধী ভাতা প্রতি জন তিন মাস পর পর ২২৫০ টাকা পান। এ টাকা দিয়ে সংসার চলে না। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের বাজারে এ টাকা দিয়ে চলা এখন কষ্টের। সরকারিভাবে কম মূল্যে যে পণ্য বিক্রি হয় তার জন্য কোনও কার্ড আমাদের দেওয়া হয় না। প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ায় সেটা থেকেও বঞ্চিত আমরা।’
আমীর হোসেনের স্ত্রী শিউলী বেগম বলেন, ছোট থেকেই দৃষ্টিহীন। এক চোখে দেখেন। ডান চোখে কিছু দেখেন না। তিনি শ্বাশুড়ির সঙ্গে পরিবারের রান্না-বান্নার কাজে সহায়তা করেন। বাবা-মা কেউ নেই তার।
হোসেন আলীর বড় মেয়ে হাসিনা আক্তার জানান, ‘আমরা চার ভাই-বোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এখন আমার সংসারেও এক ছেলে এক মেয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েছে। এখন আমরা সরকারের কাছে ভালো কোনও সহযোগিতা চাই। তারা লেখাপড়াও করতে পারে না। আড়াই বছরের শিশুটিও এখন অসহায়।’
হোসেন আলীর ছোট ছেলে জাকির হোসেন বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার সময় আমি ছোট ছিলাম। ছোট থেকে এ পর্যন্ত বেড়ে উঠলেও কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা এমনকি পড়ালেখারও সুযোগ পাইনি। আমার এক মেয়ে আছে জোনাকী। সেও দৃষ্টিহীন। দৃষ্টিহীন হয়ে জন্ম নেওয়ায় তার বয়স যখন এক বছর তখন তার মা আমাকে ও জোনাকীকে ছেড়ে চলে গেছে। আমাকে মেনে সে সংসার করলেও ভবিষ্যতে আরও সন্তান আসলে এ রকম হবে সেজন্য তার মা চলে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদেরকে সুযোগ-সুবিধা বা উন্নতমানের চিকিৎসা কেউ করাতে চায় তাহলে ভালো। আমরা সমাজের আরও ১০টা মানুষের মতো দু-মুঠো ভাত খেয়ে পড়ে চলতে চাই।’
এদিকে এলাকাবাসী কবির ও বশির বলেন, তারা খুব কষ্ট করে চলে। জনপ্রতিনিধি যারা আছে তারা তাদের খেয়াল রাখে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অনুদান পায় সেটা দিয়েও তাদের সংসার চলে না। আটজন প্রতিবন্ধী খুব কষ্ট করে চলে। এলাকার লোকজন যতটুকু পারে সাহায্য সহযোগিতা করে।
এ ব্যাপারে শ্রীপুর উপজেলা সামজসেবা কর্মকর্তা মন্জুরুল ইসলাম বলেন, মৃত হোসেন আলীর পরিবারের আটজন প্রতিবন্ধী। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করেছি। উপজেলা আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে ঘর প্রদান করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছি।
এসআইএইচ