মোটরসাইকেল দিয়ে হিরোইজম, অকালে প্রাণ ঝরছে শিক্ষার্থীদের
হিরোইজমের প্রভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোয় তরুণ-যুবকরা দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছে বেশি। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা দীর্ঘ হওয়ায় অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। টাঙ্গাইলের সড়ক-মহাসড়কে শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারায় ৮ জন শিক্ষার্থী।
জানা যায়, ঘাটাইল উপজেলার সংগ্রামপুর ইউনিয়নের এগারকাহনিয়া গ্রামে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নাঈম খান (১৫) ও শাকিল খান (১৫) নামে দাখিল পরীক্ষার্থী দুই বন্ধু নিহত হন। এ সময় তাদের অপর বন্ধু রানা মিয়া (১৭) গুরুতর আহত হন। তারা তিনজনই এবার উপজেলার মূলবাড়ী দারুস সন্নাহ দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিচ্ছিল।
এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর বিকালে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কের কালিহাতী উপজেলার জোকারচর নামক স্থানে অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় একটি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুই বন্ধু নিহত হন। এ সময় তাদের এক বন্ধু আহত হন। নিহতরা হলেন-কলেজ শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম (২২) ও সবুজ মিয়া (২৫)। তারা টাঙ্গাইল থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দিকে যাচ্ছিলেন।
১০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সখীপুরের এসএসসি পরীক্ষার্থী আদনান (১৫) মারা যান। তিনি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
৪ সেপ্টেম্বর বিকালে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর নামক স্থানে শরিফুল ইসলাম সবুজ নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হন। তিনি টাঙ্গাইল শহরের বিবেকানন্দ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ম শ্রেণির ছাত্র।
৩ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম (১৬) নিহত হন। একই দিনে সখীপুরে মোটরসাইকেল ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শামীম আল মামুন (২৫) নামে আহত এক শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রায় দিনই টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় কিশোর-যুবক শিক্ষার্থীরা অকালে প্রাণ হারাচ্ছে ও আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এ ছাড়া মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা বাড়ছে। পাড়ায়-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।
মোটরসাইকেল নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা জানান টাঙ্গাইল মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা আজহারুল হাবিব ও তানজিরুল রহমান। তাদের মতে, কিশোর বয়সের ছেলেদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তারা পরিবারের অনুশাসন মানতে চায় না। মোটরসাইকেল পেলে তারা ওভার স্পিডে চালায়। বিশেষ করে যারা বন্ধু কিম্বা আত্মীয়-স্বজনের মোটরসাইকেল নিয়ে মাঝে মাঝে চালায় তাদের মোটরসাইকেলের উপর নিয়ন্ত্রণ কম থাকে। ফলে তারাই বেশির ভাগ সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ঝান্ডা চাকলাদার জানান, স্কুল-কলেজের মোটরসাইকেল আরোহী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই ট্রাফিক সিগনালের পরোয়া করে না। তারা প্রায় ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেল রেসিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য তাদের সংগঠন বিভিন্ন ফোরামে কাজ করছে। বিশেষ করে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কিশোর-যুবকরা যেন সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো জরুরি। তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে মোটিভেশনাল কর্মসূচি নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জয়ব্রত পাল জানান, জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অপ্রতুল। তারপরও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে টিনেজার মোটরসাইকেলচালকদের জরিমানাসহ মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, টাঙ্গাইল শহরের জন্য পৃথক একটি টিম প্রতিনিয়ত টহল কার্যক্রম চালাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কার্যক্রম আরও গতিশীল করার জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলেরা মোটরসাইকেলকে কেন্দ্র করে যেন কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের (সিপিএস) সহযোগী অধ্যাপক মো. বশীর উদ্দীন খান জানান, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরণের ‘হিরোইজম’ কাজ করে। বন্ধু-বান্ধবের সাথে মোটরসাইকেল নিয়ে রেসিং করা এই বয়সের একটা বৈশিষ্ট্য। রেসিং করেতে গিয়ে তারা মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক অনুশাসনের অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর বিষয়ে সুশীল সমাজের বড় একটা ভূমিকা পালন করতে হবে।
এদিকে দেশজুড়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বিপদজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত আগস্ট মাসে সারাদেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭২ জন। মোট দুর্ঘটনার তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর নিহতের হার ৩৩ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এসআইএইচ