আন্দোলনে নিহত মাসুদ রানার শিশুকন্যা আরাবি সবার মাঝে খুঁজে ফিরছে বাবাকে
নিহত মাসুদ রানা ও তার একমাত্র শিশুকন্যা আরোবি ফেরদৌস। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
রাজধানী ঢাকায় ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন চুয়াডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান মাসুদ রানা (৩৫)। তবে একমাত্র শিশুকন্যা আরোবি ফেরদৌস জানে তার বাবা আর ফিরবে না। তবুও অবুঝ মন সবার মাঝে খুঁজে ফিরছে বাবাকে।
অন্যান্য দিনের মতো গত ৪ আগস্ট বিকালে মিরপুর-১০ নম্বরে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে পানি সরবরাহ করেন মাসুদ। এসময় আকস্মিকভাবে পুলিশের ছোড়া গুলি এসে লাগে তার মাথায়। এতে মারাত্মকভাবে জখম হন মাসুদ রানা। সহকর্মীরা তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওইদিন রাতেই তিনি মারা যান।
মাসুদ রানা ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরে বিদেশি একটি লিফট কোম্পানিতে চাকরিরত ছিলেন। মিরপুরেই স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা ও ৩ বছর বয়সী কন্যা আরোবি ফেরদৌসকে নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ঘটনার দিন ৪ আগস্ট সকালে নিজ অফিসে যান। সেখান থেকে এক বন্ধুর জন্য অফিস দেখতে যান। বিকালে পৌনে পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে সেই বন্ধুকে সাথে করে বোতলজাত পানি নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় যান। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে খাবার পানি দেওয়ার সময় পিছন দিক থেকে পুলিশ তার মাথায় গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
সহকর্মী ও আন্দোলনকারীরা তাকে প্রথমে স্থানীয় আলোক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। সেখানে মাসুদ রানার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় ঐদিনই সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রাজধানীর শ্যামলী নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানেই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐদিনই রাত সোয়া ১টার সময় সে মারা যান। রাতেই স্বজনরা নিহতের মরদেহ নিয়ে বিকাল সাড়ে ৩ টায় তার গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানা কবরস্থানে সমাহিত করে হাজারো মানুষ শোকাবহ বেদনা বিধুর পরিবেশে। মাসুদ রানার এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে পিতা হারিয়েছেন বাকশক্তি, আর মাতার চোখ থেকে সব সময় জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। বড়ভাই ছোট ভাই হারানোর শোকে হতবিহ্বল। স্ত্রী অসময়ে স্বামীকে হারিয়ে কান্নার শক্তিও হারিয়েছেন। ৩ বছরের মিষ্টি মেয়েটি উপস্থিত সকলের মাঝে তার বাবাকে খুঁজে ফিরছে অহর্নিশি।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা ইউনিয়নের কয়রাডাঙ্গা গ্রামের কৃষিজীবী রায়হান বিশ্বাসের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে মাসুদ রানা ছিল সবার ছোট। রানার মায়ের নাম জাহানারা বেগম। মাসুদ রানা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী গোকুল খালী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করেন। এরপর তিনি ঢাকায় একটি লিফট কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে চাকরি শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি নিজেই বিদেশ থেকে লিফট ইমপোর্ট করে দেশে বাজারজাত করে আসছিলেন।
দেশব্যাপী জুলাই মাসে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে ছাত্র-জনতার এক কাতারে সম্পৃক্ততার কারণে আন্দোলনে গতি পায়। এর চূড়ান্ত পর্যায়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের এক দফা ঘোষণার ফলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এ পর্যায়ে এসে অনেক সহৃদয় ব্যক্তির মত মাসুদ রানাও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্তর থেকে গভীর টান অনুভব করেন। সেই তাগিদ থেকেই সে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতার মাঝে নিয়মিতভাবেই খাবার পানি সরবরাহ করে আসছিলেন।
এই উদ্দেশ্যেই তিনি অন্যান্য দিনের মতো কয়েকজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে ৪ আগস্ট বিকাল পাঁচটার দিকে মিরপুর ১০ এলাকায় আন্দোলনরতদের মাঝে বোতলজাত খাবার পানি নিয়ে উপস্থিত হন। পানি সরবরাহের এক পর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে। পিছন দিক থেকে মাথায় গুলি লাগলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাতেই হাসপাতালে নির্মমভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায় একটি পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা এবং বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন। ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সরবরাহকৃত মাসুদ রানার ডেথ সার্টিফিকেটে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ রয়েছে।
নিহত মাসুদ রানার মা জাহানারা বেগম বলেন, আমার ছোট ছেলে কত আদরের জীবনে কত কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছি। ঢাকায় গেলো ব্যবসা করতে। কীভাবে কী হয়ে গেল এখন আমার ছেলেকে কোথায় পাব? কে তাকে ফিরিয়ে দেবে? পরিবার নিয়ে পথে বসার মত অবস্থায় পড়েছি।
বড়ভাই ব্যবসায়ী বাবুল আকতার বলেন, রানা আমাদের পরিবারের সকলের ছোট, সবার আদরের। তাকে আমরা ঢাকাতে পাঠাতে চাইনি, কিন্তু সে ঢাকাতে যায় সেখানে লেখা পড়া শেষ করে একটি লিফট কোম্পানিতে চাকরি করতো । এখন সে নিজেই একটা অফিস করে কোম্পানি খুলে ব্যবসা করে আসছিলেো। আল্লাহর রহমতে সে অনেক ভালো ছিল । আজকে সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তে সে মারা গেছে। ঘটক পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
নিহত মাসুদ রানার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সাফা বলেন, ঐদিন সকালে আমি তাকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম, বললাম আজকে তো দেশের অবস্থা অনেক খারাপ তুমি বাইরে যেও না। কিন্তু সে আমাকে বলল অফিসে কাজ আছে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। সারাদিন তাকে অনেকবার ফোন দিয়েছি তাকে ফোনে পাইনি। এরপর সন্ধ্যার পরে তার এক বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে জানাই সে গুলি খেয়ে হাসপাতালে আছে। আমি হাসপাতালে গিয়েছি আমাকে কেউ তার কাছে যেতে দেয়নি সে আইসিইউতে ছিল রাত সোয়া ১ টার দিকে সে মারা যায়। আমাকে তারপরে তার কাছে যেতে দেয়া হয়। আমি এত ছোট মেয়েটাকে নিয়ে এখন কোথায় যাবো কি করবো? আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই, যারা আমার এই অবুঝ বাচ্চাটাকে এতিম করলো আমি তাদের বিচার চাই।
চিৎলা ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আলমগীর হোসেন বলেন, মাসুদ রানা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-জনতার সাথে ছিলেন। সে পুলিশে গুলিতে নিহত হয়েছেন সে একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আমি দাবি জানাবো এই অসহায় পরিবারের প্রতি সরকার যেন একটু সুদৃষ্টি দেয়।