কুমিল্লায় ১২ দিনে সড়কে ঝরল ১৪ জনের প্রাণ
সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লার বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশ ছাড়াও কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কসহ অন্যান্য সড়কে এসব দুর্ঘটনায় ঝরেছে তাজা প্রাণ। আহত হয়ে অনেককে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন। গত ১২ দিনে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশে।
ঈদুল ফিতরের আগের দিন থেকে এ পর্যন্ত চোদ্দগ্রামে মারা গেছেন ৬ জন। এ ছাড়া মুরাদনগরে ২জন, লালমাইয়ে ২ জন, দাউদকান্দিতে ২জন, সদর উপজেলায় একজন এবং চান্দিনায় একজন মারা যান। গত ২১ এপ্রিল থেকে ৩ মে (বুধবার) পর্যন্ত সময়ে এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। সংশ্লিষ্ট থানা ও হাইওয়ে পুলিশ এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সর্বশেষ আজ বুধবার সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর উপজেলার আমতলী এলাকায় শ্যামলী বাসের ধাক্কায় এক পথচারী নিহত হয়েছেন। দুপুর পর্যন্ত তার নাম পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে স্টারলাইন পরিবহনের বাসের চাপায় এরশাদ (৩২) নামে এক দিনমজুর নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় উত্তেজিত জনতা মহাসড়কে স্টারলাইন পরিবহনের ১৫টি গাড়ি আধাঘণ্টা আটকে রাখে এবং ওই পরিবহনের কাউন্টারে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুভরঞ্জন চাকমা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দিতে গাড়িচাপায় এক অজ্ঞাত নারী পথচারী নিহত হয়েছেন। বুধবার পর্যন্ত তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, নিহত ওই নারীর পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
তার আগের দিন শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা-কালিকাপুর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাদেকা সারোয়ার রাইয়ান নামে ফেনী ক্যাডেট কলেজের এক ছাত্রী নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় গাড়িতে থাকা তার মা মেজর শামীমা সুমি ও পিতা লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া সারোয়ার এবং গাড়িচালক উজ্জল খান মারাত্মক আহত হন।
বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুম্বপুরে মহাসড়ক পারাপারের সময় বাসচাপায় নাজমা বেগম (৫০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। নিহত নাজমা বেগম চান্দিনা উপজেলার গল্লাই ইউনিয়নের পাঁচধারা গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের স্ত্রী।
তার আগের দিন বুধবার (২৬ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুমিল্লার লালমাই উপজেলার হরিশ্চর-ভূশ্চি সড়কের কামারকুয়া বুশ মার্কেটের সামনে সিএনজির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেলের চালক জাহিদ হোসেন (২৭) নিহত হন। নিহত জাহিদ হোসেন উপজেলার বেলঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের গৈয়ারভাঙ্গা শ্রীপুর গ্রামের মো.মফিজুর রহমান ছেলে। গত ২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার লালমাইয়ে বাসচাপায় রাহুল সিং (৫৫) নামে এক গ্রাম পুলিশ নিহত হন। তিনি লালমাই উপজেলা কমপ্লেক্সে ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে কুমিল্লা নোয়াখালী আঞ্চলিক সড়কের বাগমারা অশ্বত্থতলা উপজেলা কৃষি অফিসের সামনে ঢাকা থেকে রায়পুরগামী ঢাকা এক্সপ্রেস তাকে চাপা দেয়। দুর্ঘটনার পর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রাহুল সিংয়ের উপজেলার বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নের ঘনিয়াখালী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নে গ্রাম পুলিশে চাকরি করতেন।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল শুক্রবার সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মেয়েসহ তিনজন নিহত হয়। উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কালিকাপুর ও দুপুরে ঘোলপাশা ইউনিয়নের সৈয়দপুর রাস্তার মাথায় দুর্ঘটনাটি ঘটে।
২৪ এপ্রিল সোমবার রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারের চাপায় শাওন (১২) নামে এক শিশু পথচারী নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হন আরও ৭ জন। উপজেলার ঘোলপাশা ইউনিয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আমানগন্ডা বাজারে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত শাওন ইউনিয়নের আমানগন্ডা খিলপাড়া গ্রামের প্রবাসী মোস্তফার ছেলে।
অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির আমিরাবাদে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী এক শিশু ঘটনাস্থলে মারা গেছে। দুর্ঘটনায় শিশুটির বাবা-মা গুরুতর আহত হয়। আহতদের গৌরীপুর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। নিহত কন্যা শিশু তানহা (৭) কুমিল্লা সদরের কালির বাজার গ্রামের রুবেল মিয়ার মেয়ে। দুর্ঘটনায় শিশুটির বাবা রুবেল মিয়া (৩৫) এবং মা ময়না (২৮) মারাত্মক আহত হয়। তারা তিনজন মোটরসাইকেলযোগে দাউদকান্দির দিকে যাচ্ছিলেন।
এ ছাড়া কুমিল্লার মুরাদনগরে পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশ সদস্যসহ দুইজন নিহত ও ৪ জন আহত হয়েছেন। ২১ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় উপজেলার নহল চৌমুহনী এবং ২২ এপ্রিল শনিবার দুপুরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের থোল্লার মোড় এলাকায় দুর্ঘটনা দুটি ঘটে। নিহতরা হলেন- মুরাদনগর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ উদ্দিনের ছেলে ইমরুল কায়েস পিয়াস (৩১)। তিনি চাঁদপুর জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী ও ৩ ছেলে রয়েছে। অপর দুর্ঘটনায় নিহত সাইয়েম (১৮) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার সায়েদাবাদ গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় তার আরও ৪ বন্ধু আহত হন। তাদের চিকিৎসার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিকে হঠাৎ করে কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই কুমিল্লা উত্তর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক লিটন সরকার বাদল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মাঝের কিছুদিন কুমিল্লার সড়কে শৃঙ্খলা ছিল, দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানিও কম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তা আবার বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ঈদের আগের দিন থেকে আজ পর্যন্ত কুমিল্লার সড়কে প্রায় ১৪ জনের প্রাণহানির খবর আমরা পেয়েছি। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালক ও পথচারী সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে- একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।
কুমিল্লার ময়নামতি ক্রসিং হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মহাসড়ককে মোবাইল ডিউটি বাড়ানো হয়েছে, চালকদের প্রশিক্ষণ ও তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রতি মাসে বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪-৫টি আলোচনা সভা করা হচ্ছে চালকদের সঙ্গে। এ ছাড়া প্রতিদিনই, বিশেষ করে রাতে গাড়ি থামিয়ে আমরা চালকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছি। যেন কোনো প্রকার দুর্ঘটনা কিংবা প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে। একইসঙ্গে পথচারীদেরকেও সতর্ক করা হচ্ছে। তারা যেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হুট করে সড়ক পারাপার না করে, পথচারী সেতু ব্যবহার করে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই।
এসজি